ঘুমের মধ্যেই শুনলাম কে যেন ডাকল, হিমু, এই হিমু।
গলার স্বর একইসঙ্গে চেনা এবং অচেনা। যে ডাকছে তার সঙ্গে অনেক বছর আগে পরিচয় ছিল, এখন নেই। মানুষটাকে ভুলে গেছি, কিন্তু স্মৃতিতে তার গলার স্বর রয়ে গেছে।পুরুষালী ভারী গলা।একটু শ্লেষ্মা জড়ানো। আমি আধোঘুমে জবাব দিলাম, কে? কেউ উত্তর দিল না। ভয়াবহ ধরণের নিরবতা। আমি আবার বললাম, কে? কে ওখানে? ছোট্ট করে কেউ নিঃশ্বাস ফেলল। আশ্চর্য! নিঃশ্বাস ফেলার শব্দটাও আমার চেনা। টুক টুক করে দু‘বার শব্দ হল দরজায়। দরজার ওপাশের মানুষটি চাপা গলায় ডাকল, হিমু, এই হিমু। আমার অস্বস্তিবোধ হতে লাগল। ঘর অন্ধকার, গাঢ় অন্ধকার। রাতে বৃষ্টি হচ্ছিল বলে দরজা—জানালা বন্ধ করে শুয়েছি।রেডিয়াম ডায়ালের টেবিল ঘড়ি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাওয়ার কথা নয়, কিন্তু সবকিছু পরিষ্কার দেখছি। ঐ তো দেয়ালের ক্যালেন্ডার দেখা যাচ্ছে। ক্যালেন্ডারের লেখাগুলি পর্যন্ত পড়তে পারছি।এর মানে কি? এটা কি তাহলে স্বপ্ন? পুরো ব্যাপারটা ঘটছে স্বপ্নে? দরজার ওপাশে আসলে কেউ নেই? চেনা এবং অচেনা গলায় আমাকে ডাকছে না? ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখিছি, এবং ঘুমের মধ্যেই বুঝতে পারছি এটা স্বপ্ন। স্বপ্নটা শেষ পর্যন্ত দেখতে ইচ্ছা করছে না। আমি দরজা খুলে দেখতে চাই না—দরজার ওপাশে কে দাঁড়িয়ে আছে। আমার জানার কোন ইচ্ছা নেই—ভারি গলায় কে আমাকে ডাকছে।আমি জেগে ওঠার চেষ্টা করছি। জাগতে পারছি না।কেউ আমাকে স্বপ্নের শেষটা দেখাতে চায়, আমি দেখতে চাই না। প্রচণ্ড অস্বস্তিতে ঘুমের মধ্যেই ছটফট করতে করতে আমি জেগে উঠলাম।
ঘরের হাওয়া গরম হয়ে আছে। দরজা-জানালা বন্ধ্ কিছু দেখা যাচ্ছে না। আমি বাতি জ্বালালাম। স্বপ্নে দেয়ালে যে জায়গায় ক্যালেন্ডার ছিল সেখানে ক্যালেন্ডার নেই। খাটের নিচে টকটক শব্দ হচ্ছে। প্রায়ই হয়। কিসের শব্দ আমার জানা নেই। ইঁদুর হবে না, ইঁদুর টকটক শব্দ করে না। আমি হাতড়ে হাতড়ে দরজা খুললাম।
ভোর হয়েছে। আলো হয়ে আছে চারদিক। আমার দরজা-জানালা বন্ধ ছিল বলেই ঘর হয়েছিল অন্ধকার। বারান্দায় এসে দেখি, পাশের ঘরের বায়েজিদ সাহেব বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁত মাজছেন। তাঁর চোখ টকটকে লাল। এটা কোন নতুন ব্যাপার না। বায়েজিদ সাহেবের চোখ সব সময়ই লাল।তিনি আমাকে দেখে নিচু গলায় বললেন, কি ব্যাপার হিমু সাহেব? এত সকালে জেগে উঠেছেন, ব্যাপার কি?
‘ঘুম ভেঙ্গে গেল।’
‘সুবেহ সাদেকের সময় ঘুম ভাঙ্গা ভাল। এই সময় আল্লাহ পাক বেহেশতের জানালা খুলে রাখেন। ঐ জানালা দিয়ে বেহেশতের হাওয়া আসে পৃথিবীতে। ঐ হাওয়া যাদের গায়ে লাগে তারা বেহেশতবাসী হয়।’
‘কে বলেছে আপনাকে?’
তিনি অস্বস্তির সঙ্গে বললেন, শোনা কথা।
‘আপনি কি এই জন্যেই রোজ ভোরে উঠে বেহেশতের হাওয়া গায়ে লাগান?’
বায়েজিদ সাহেব লজ্জিত ভঙ্গিতে হেসে ফেললেন। ভোরবেলা অদ্ভুদ আলোর কারণেই তাঁকে আজ অনেক কম বয়স্ক মনে হচ্ছে। ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। তাঁকে দেখে আমার সবসময় মনে হয়েছে তাঁর গা থেকে কেউ একজন লেবুর মত সমস্ত রস চিপে নিয়ে নিয়েছে। হাঁটেন খানিকটা কুঁজো হয়ে। চোখে চোখ পড়লে চোখ নামিয়ে নেন। রাস্তায় দেখা হলে যদি জিজ্ঞেস করি, কেমন আছেন বায়েজিদ সাহেব? তিনি বিব্রত গলায় কোন রকমে বলেন, এই আছি। ছুটির দিনে তিনি তাঁর ঘরে থাকেন। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ থাকে। ছুটির দিনগুলিতে মেসে একটু ভাল খাওয়া-দাওয়া হয়। সবাই একসঙ্গে বসে খায়। তিনি কখনো বসেন না। সবার খাওয়া হয়ে গেলে এক সময় চুপি চুপি খেতে যান। মাথা নিচু করে অতি দ্রুত খাবার পর্ব শেষ করেন। যেন খাওয়া একটা অন্যায় কাজ। যত দ্রুত শেষ করা যায়, তত ভাল। এই লোক আমাকে দেখে এতগুলি কথা বলবে, ভাবা যায় না। আমি তাঁর দিকে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে বললাম, বেহেশতের জানালা খোলার ব্যাপার যখন আছে তখন দোজখের জানালা খোলার ব্যাপারও থাকার কথা। ঐটা কখন খোলা থাকে জানেন?
‘রাত বারোটা থেকে সুবেহ সাদেকের আগ পর্যন্ত। এই জন্যে এই সময় ঘরের ভেতর থাকার বিধান আছে। সবই অবশ্য শোনা কথা। সত্যি মিথ্যা জানি না।’
আমি হাসতে হাসতে বললাম, সত্যি হলে আমার জন্যে খুব মুশকিল। আমার অভ্যাস হল গভীর রাতে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করা।
বায়েজিদ সাহেব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমি জানি। তবে আপনার জন্যে কোন সমস্যা নাই।
‘সমস্যা নেই কেন?’
‘আপনি সঠিক মানুষ।’
‘আমি সঠিক মানুষ আপনাকে কে বলল? রাত-বিরাতে রাস্তায় হাঁটলেই মানুষ সঠিক হয়ে যায়? তাহলে তো চোর পুলিশ সবচে’ বড় সঠিক।’
বায়েজিদ সাহেব আবার মাথা নিচু করে ফেললেন। সম্ভবত তিনি আর কথা বলবেন না। একদিনে বেশি কথা বলে ফেলেছেন। তাঁর সঙ্গে আমার কথা বলতে ভাল লাগছে। ভদ্রলোক দু’বছরের উপর আমার পাশের ঘরে আছ্নে। এই দু’বছরে তাঁর সঙ্গে আমার তিন চার বারের বেশি কথা হয়নি। সেই সব কথাও—‘কেমন আছেন বায়েজিদ সাহেব?’ ‘এই আছি।’ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ ভদ্রলোক কি করেন, তাঁর দেশ কোথায়, তাঁর চোখ সবসময় টকটকে লাল কেন কিছুই জানি না।
‘বায়েজিদ সাহেব।’
‘জ্বি।’
‘কাল রাতে অনেকক্ষণ জেগেছিলাম। রেসকোর্সের ভেতরে হেঁটে হেঁটে দোজখের হাওয়া লাগাচ্ছিলাম। বৃষ্টি যখন শুরু হল তখন ঘরে এসেছি। এত সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গার কথা না। স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গেছে। স্বপ্নটা পুরোপুরি দেখতেও পারিনি। মনে হচ্ছিল দুঃস্বপ্ন। দেখতে ইচ্ছা করছিল না বলে দেখিনি। জেগে উঠেছি।’
বায়েজিদ সাহেব শান্ত গলায় বললেন, সুবেহ সাদেকের সময় আল্লাহপাক কাউকে দুঃস্বপ্ন দেখান না।
‘তাই না-কি?’
‘জ্বি। সুবেহ সাদেক কুব একটা ভাল সময়। এই সময় আল্লাহপাক মানুষকে মঙ্গলের কথা বলেন, আনন্দের কথা বলেন।’
‘এটাও কি মওলানার কাছ থেকে শোনা কথা?’
‘জ্বি-না, আমার স্ত্রীর কথা। সে জীবিত নেই। উনিশ বছর আগে মারা গেছে। আমার কন্যার জন্মের সময় মারা গেল। সে জীবিত থাকার সময় অদ্ভুদ অদ্ভুদ কথা বলত। তখন হাসাহাসি করতাম। এখন করি না। এখন তার সব কথাই সত্যি মনে হয়।’
‘বেহেশত এবং দোজখের জানালার কথাও কি তাঁর কথা?’
‘জ্বি।
‘আপনার স্ত্রীর মৃত্যুর পর আপনি আর বিয়ে করেন নি?’
‘জ্বি-না।
‘আপনার মেয়েটির বয়স তাহলে এখন উনিশ?’
‘জ্বি।
‘তাঁর কি বিয়ে হয়েছে?’
‘জ্বি-না।’
‘সে থাকে কোথায়?’
‘তার মামাদের কাছে থাকে। নিজের কাছে এনে রাখতে চেয়েছিলাম। সামর্থ্য হল না।অতি ছোট চাকরি করি । বেতন যা পাই তা দিয়ে ঢাকায় ঘর ভাড়া করে থাকা সম্ভব না।’
‘আমি আপনাকে অনেক ব্যক্তিগত প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে ফেললাম। কিছু মনে করবেন না।’
‘জ্বি-না। আমি কিছুই মনে করি নি। আমি খুব খুশি হয়েছি। অনেক দিন থেকে আপনার সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলাম। সাহসে কুলায়নি।’
‘আমাকে বলতে চাচ্ছিলেন কেন?’
‘আপনি মহাপুরুষ ধরণের মানুষ। আপনি আমার মেয়েটার জন্যে একটু প্রার্থনা করলে তার মঙ্গল হবে, এই জন্যে। মেয়েটার বিয়ে দিতে পারছি না। দুষ্ট লোকজন আমার মেয়েটার নামে বাজে একটা দুর্নাম ছড়িয়েছে। পুরো ব্যাপারটা যে মিথ্যা সবাই জানে, কেউ বিশ্বাস করে না, আবার সবাই বিশ্বাস করে। মেয়েটা খুব কষ্টে আছে ভাই সাহেব। আমি জানি, আপনি মেয়েটার কষ্ট কমাতে পারবেন। আমার মেয়েটা যে কত ভাল তা একমাত্র আমি জানি আর জানেন আল্লাহপাক। আপনার কাছে আমি হাতজোড় করছি।’
বায়েজিদ সাহেব সত্যি সত্যি হাতজোড় করলেন। আমি বিব্রত গলায় বললাম, ভাই, আপনি আমার হলুদ পাঞ্জাবি, লম্বা দাড়ি-গোঁফ দেখে বিভ্রান্ত হয়েছেন। আপনার দোষ নেই, অনেকেই হয়। বিশ্বাস করুন, আমি মহাপুরুষ না। অতি সাধারণ মানুষ।প্রচুর মিথ্যা কথা বলি, অনেক ধরণের ভড়ং করি। মানুষকে হকচকিয়ে দেয়ার একটা সচেতন চেষ্টা আমার মধ্যে থাকে। কাজকর্ম করার কোন ক্ষমতা নেই বলেই আমি ভবঘুরে। বুঝতে পারছেন?’
বায়েজিদ সাহেব আগের মত কোমল গলায় বললেন, আপনি একটু দোয়া করবেন আমার মেয়েটার জন্যে। অনেকদিন বলার চেষ্টা করেছি। সাহস পাইনি। আজ আল্লাহপাক সুযোগ করে দিয়েছেন।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, ঠিক আছে, প্রার্থনা করলাম। অসম্ভব রুপবান এবং ধনবান ছেলের সঙ্গে আপনার কন্যার বিয়ে হবে। তারা দু’জনে মিলে ঘুরবে দেশ থেকে দেশান্তরে।
বায়েজিদ সাহেব ক্ষীণ গলায় বললেন, আপনার অসীম শুকরিয়া।
আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মহাপুরুষদের মতেই গম্ভীর ভঙ্গিতে নিচে নেমে গেলাম। ভাল যন্ত্রনা হয়েছে। আমারেক অলৌকিক ক্ষমতাধর মনে করে এমন লোকের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে।একটা আশ্রম-টাশ্রম খুলে বসার সময় বোধহয় হয়ে এসেছে। কমন বাথরুম নিচে। এত ভোরে কেউ উঠেনি। বাথরুম খালি পাওয়া যাবে। কল ছেড়ে কিছুক্ষণ মাথা পেতে বসে থাকব। তারপর পর পর তিন কাপ চা খেতে হবে। রাতে ঘুম না হওয়ায় মাথা জাম হয়ে আছে। চা খেয়ে রফিকের বাসায় একবার যেতে হবে। সে গত এক সপ্তাহ ধরে দু’দিন পর পর আমার কাছে আসছে।
কখনো দেখা হচ্ছে না। সে এমন সময় আসে যখন আমি থাকি না। তার ব্যাপারটি কি, কে জানে?
বাথরুমের বেসিন অনেকদিন ধরেই ভাঙ্গা। আজ দেখি নতুন বেসিন। বেসিনের উপর নতুন আয়না। মেসের মালিক বসিরুদ্দিন সাহেব খরচের চুড়ান্ত করেছেন বলে মনে হচ্ছে। বেসিনের কাছে না গিয়েও বলতে পারছি কোন রিজেকটেড বেসিন বসিরুদ্দিন সাহেব কুঁড়িয়ে এনে ফিট করে দিয়েছেন। আয়নাটাও হবে ঢাকা শহরের সবচে সন্তা আয়না। মুখ দেখা যাওয়ার কোন কারণ নেই। আয়না দেখলেই আমার কাছে দাঁড়াতে ইচ্ছা করে। খুবই ক্ষুদ্র ইচ্ছা। এবং নির্দোষ ইচ্ছা। তবু অতি ক্ষুদ্র ইচ্ছাকে প্রশ্রয় দিতে নেই। একবার প্রশ্রয় দেয়া শুরু করলে সব ইচ্ছাকেই প্রশ্রয় দিতে মন চাইবে। ‘‘যে মানব সন্তান ক্ষুদ্র কামনা জয় করতে পারে সে বৃহৎ কামনাও জয় করতে পারে।’’ এই মহৎ বাণী আমার বাবার। চামড়ায় বাঁধানো তিনশ একুশ পৃষ্টার একটা খাতায় তিনি এইসব বাণী মু্ক্তার মত গোটা গোটা হরফে লিখে রেখে গেছেন। পুরো খাতাটাই হয়তো ভরে ফেলার ইচ্ছা ছিল। সময় পাননি। মাত্র চার দিনের নোটিসে তাঁকে পৃথিবী ছাড়তে হল। জ্বর হল। জ্বরের চতুর্থ দিনে বিস্ময় এবং দুঃখ নিয়ে তাঁকে বিদায় নিতে হল। আমাকে হতাশ গলায় বললেন, আসল কথা তোকে কিছুই বলা হল না। অল্প কিছু লিখেছি—এতে কিছুই হবে না। তিনি আঠারো পৃষ্টা পর্যন্ত লিখেছেন। কিছু কিছু বাণী লেখার পরও কেটে ফেলা হয়েছে, তাঁর পছন্দ হয়নি। বাণীল মধ্যেও ভেজাল আছে। এ রকম একটা ভেজাল বাণী হল:
‘‘হে মানব সন্তান, সুখের স্বরুপ নির্ধারণের চেষ্টা কর। যে সুখের স্বরুপ জেনেছে সে দুঃখ জেনেছে। দুঃখের বাস সুখের মাঝখানে।’’
এই বাণ লাল কালি দিয়ে কেটে তার নিচে বাবা লিখেছেন—ভাব অস্পষ্ট ও ধোঁয়াটে।
কলের নিচে মাথা পেতে মনে হল জগৎ সংসারে সবটাই কি অস্পষ্ট ও ধোঁয়াটে নয়? স্বপ্নকে আমরা অস্পষ্ট । বাস্তব কি স্বপ্নের চেয়েও অস্পষ্ট নয়?
শুধু মাথা ভেজানোর জন্যে গিয়েছিলাম, পুরো শরীর ভিজিয়ে ফেললাম। আরাম লাগছে। একটু শীত ভাব হচ্ছে—আরামদায়ক শীত ভাব। অর্থ্যাৎ আমি সুখ পাচ্ছি। এই সুখের স্বরুপ জানলেই দুঃখ কি তা জেনে ফেলব। ভেজাল বাণী তাই বলেছে। চোখ বন্ধ করে কলের নিচে মাথা পেতে আছি। সারাদিন এভাবে বসে থাকলে কেমন লাগবে। চোখ বন্ধ থাকায় বৃষ্টির মত লাগছে। মনে হচ্ছে আষাঢ় মাসের মুষল বর্ষণে গা পেতে আছি।
মেসের ঠিকা ঝি ময়নার মা’র কথা কানে না এলে কল্পনা আরো ফেনানো যেত। ময়নার মা চলে এসেছে। সে কথা না বলে এক মুহুর্ত থাকতে পারে না। আশেপাশে কেউ নেই বলে কথা বলছে বাসনগুলির সঙ্গে। মানুষের সঙ্গে কথা বললে তেমন কৌতুহলী হতাম না। বাসন কোসনের সঙ্গে কথা বলছে বলেই কৌতুহলী হয়ে শুনতে ইচ্ছা হচ্ছে। মানুষ শুধু যে প্রাণী জগতের সঙ্গেই সম্পর্ক স্থাপন করতে চায় তাই না, জড় জগতের সঙ্গেও চায়। ময়নার মা চাপা গলায় গভীর বেদনার সঙ্গে বলছে, চেপ্টা থালা। আমিও চেপ্টা, তুইও চেপ্টা। আমার চেপ্টা কপাল, তরও চেপ্টা কপাল। কান্দাভাঙা ডেকচি। তর যেমন কান্দাভাঙা, আমারও কান্দাভাঙা। তর কান্দা ভাঙছি আমি ময়নার মা। ক’দেহি আমার কান্দা কে ভাঙছে?
ময়নার মা’র কথা শোনার ইচ্ছা করছে, ক্ষুদ্র এবং নির্দোষ ইচ্ছা। এটা ঠিক হচ্ছে না। কলের পানি আরো জোরে ছাড়তে পারলে কাজ হতো। পানিতে আর জোর নেই। আমি বাথরুম থেকে বের হয়ে এলাম। ময়নার মা আমাকে দেখে লম্বা ঘোমটা দিল। ঘোমটার আড়াল থেকে বলল, আব্বার শইল ভাল? সে গোড়া থেকেই আব্বা ডাক ধরেছে। নিষেধে কাজ হয়নি।
‘ভাল। তুমি কেমন আছ, ময়নার মা?’
‘আমি হইলাম আফনের কান্দাভাঙা ডেগ। আফনের মাথার দরদ কমছে?’
‘কয়েকদিন হচ্ছে না।’
‘বদ্যি গেরামের একখান তেল আছে, মাথার দরদে খুব আরাম। আফনেরে আইন্যা দিমু।’
‘আচ্ছা দিও।’
‘দেশের বাড়িত কেউ নাই, যাওয়া পড়ে না। আফনের জইন্যে যামু।’
আমি চুপ করে রইলাম। আমার দিক থেকে কোন সাড়া পেলে সে কথা বলা থামাবে না।
‘মাথার দরদ ভাল জিনিস না। ময়নার বাবা মরল মাথার দরদে। ফাল্গুন মাসে আমার পরথম বলল, আইজ কাজে যামু না—মাথার মইদ্যে দরদ। আমি কইলাম এইটা কেমুন কথা? মাথার মইদ্যে দরদ হইছে বইল্যা কাম কামাই করবেন? যান কামে যান। তা ধরেন মানুষটা গেল…।
ময়নার মা’র এই গল্প আগেও কয়েকবার শোনা। আবারো শুনতে ইচ্ছা হচ্ছে। ভেজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে গল্প শুনছি। শুনতে মোটেও ইচ্ছা করছে না। গল্পটা আবার বলতে পেরে সে যতটা আনন্দ পাচ্ছে আমি ঠিক ততটাই বিরক্ত হচ্ছি। সব মিলে সমান সমান।
গলার স্বর একইসঙ্গে চেনা এবং অচেনা। যে ডাকছে তার সঙ্গে অনেক বছর আগে পরিচয় ছিল, এখন নেই। মানুষটাকে ভুলে গেছি, কিন্তু স্মৃতিতে তার গলার স্বর রয়ে গেছে।পুরুষালী ভারী গলা।একটু শ্লেষ্মা জড়ানো। আমি আধোঘুমে জবাব দিলাম, কে? কেউ উত্তর দিল না। ভয়াবহ ধরণের নিরবতা। আমি আবার বললাম, কে? কে ওখানে? ছোট্ট করে কেউ নিঃশ্বাস ফেলল। আশ্চর্য! নিঃশ্বাস ফেলার শব্দটাও আমার চেনা। টুক টুক করে দু‘বার শব্দ হল দরজায়। দরজার ওপাশের মানুষটি চাপা গলায় ডাকল, হিমু, এই হিমু। আমার অস্বস্তিবোধ হতে লাগল। ঘর অন্ধকার, গাঢ় অন্ধকার। রাতে বৃষ্টি হচ্ছিল বলে দরজা—জানালা বন্ধ করে শুয়েছি।রেডিয়াম ডায়ালের টেবিল ঘড়ি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাওয়ার কথা নয়, কিন্তু সবকিছু পরিষ্কার দেখছি। ঐ তো দেয়ালের ক্যালেন্ডার দেখা যাচ্ছে। ক্যালেন্ডারের লেখাগুলি পর্যন্ত পড়তে পারছি।এর মানে কি? এটা কি তাহলে স্বপ্ন? পুরো ব্যাপারটা ঘটছে স্বপ্নে? দরজার ওপাশে আসলে কেউ নেই? চেনা এবং অচেনা গলায় আমাকে ডাকছে না? ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখিছি, এবং ঘুমের মধ্যেই বুঝতে পারছি এটা স্বপ্ন। স্বপ্নটা শেষ পর্যন্ত দেখতে ইচ্ছা করছে না। আমি দরজা খুলে দেখতে চাই না—দরজার ওপাশে কে দাঁড়িয়ে আছে। আমার জানার কোন ইচ্ছা নেই—ভারি গলায় কে আমাকে ডাকছে।আমি জেগে ওঠার চেষ্টা করছি। জাগতে পারছি না।কেউ আমাকে স্বপ্নের শেষটা দেখাতে চায়, আমি দেখতে চাই না। প্রচণ্ড অস্বস্তিতে ঘুমের মধ্যেই ছটফট করতে করতে আমি জেগে উঠলাম।
ঘরের হাওয়া গরম হয়ে আছে। দরজা-জানালা বন্ধ্ কিছু দেখা যাচ্ছে না। আমি বাতি জ্বালালাম। স্বপ্নে দেয়ালে যে জায়গায় ক্যালেন্ডার ছিল সেখানে ক্যালেন্ডার নেই। খাটের নিচে টকটক শব্দ হচ্ছে। প্রায়ই হয়। কিসের শব্দ আমার জানা নেই। ইঁদুর হবে না, ইঁদুর টকটক শব্দ করে না। আমি হাতড়ে হাতড়ে দরজা খুললাম।
ভোর হয়েছে। আলো হয়ে আছে চারদিক। আমার দরজা-জানালা বন্ধ ছিল বলেই ঘর হয়েছিল অন্ধকার। বারান্দায় এসে দেখি, পাশের ঘরের বায়েজিদ সাহেব বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁত মাজছেন। তাঁর চোখ টকটকে লাল। এটা কোন নতুন ব্যাপার না। বায়েজিদ সাহেবের চোখ সব সময়ই লাল।তিনি আমাকে দেখে নিচু গলায় বললেন, কি ব্যাপার হিমু সাহেব? এত সকালে জেগে উঠেছেন, ব্যাপার কি?
‘ঘুম ভেঙ্গে গেল।’
‘সুবেহ সাদেকের সময় ঘুম ভাঙ্গা ভাল। এই সময় আল্লাহ পাক বেহেশতের জানালা খুলে রাখেন। ঐ জানালা দিয়ে বেহেশতের হাওয়া আসে পৃথিবীতে। ঐ হাওয়া যাদের গায়ে লাগে তারা বেহেশতবাসী হয়।’
‘কে বলেছে আপনাকে?’
তিনি অস্বস্তির সঙ্গে বললেন, শোনা কথা।
‘আপনি কি এই জন্যেই রোজ ভোরে উঠে বেহেশতের হাওয়া গায়ে লাগান?’
বায়েজিদ সাহেব লজ্জিত ভঙ্গিতে হেসে ফেললেন। ভোরবেলা অদ্ভুদ আলোর কারণেই তাঁকে আজ অনেক কম বয়স্ক মনে হচ্ছে। ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। তাঁকে দেখে আমার সবসময় মনে হয়েছে তাঁর গা থেকে কেউ একজন লেবুর মত সমস্ত রস চিপে নিয়ে নিয়েছে। হাঁটেন খানিকটা কুঁজো হয়ে। চোখে চোখ পড়লে চোখ নামিয়ে নেন। রাস্তায় দেখা হলে যদি জিজ্ঞেস করি, কেমন আছেন বায়েজিদ সাহেব? তিনি বিব্রত গলায় কোন রকমে বলেন, এই আছি। ছুটির দিনে তিনি তাঁর ঘরে থাকেন। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ থাকে। ছুটির দিনগুলিতে মেসে একটু ভাল খাওয়া-দাওয়া হয়। সবাই একসঙ্গে বসে খায়। তিনি কখনো বসেন না। সবার খাওয়া হয়ে গেলে এক সময় চুপি চুপি খেতে যান। মাথা নিচু করে অতি দ্রুত খাবার পর্ব শেষ করেন। যেন খাওয়া একটা অন্যায় কাজ। যত দ্রুত শেষ করা যায়, তত ভাল। এই লোক আমাকে দেখে এতগুলি কথা বলবে, ভাবা যায় না। আমি তাঁর দিকে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে বললাম, বেহেশতের জানালা খোলার ব্যাপার যখন আছে তখন দোজখের জানালা খোলার ব্যাপারও থাকার কথা। ঐটা কখন খোলা থাকে জানেন?
‘রাত বারোটা থেকে সুবেহ সাদেকের আগ পর্যন্ত। এই জন্যে এই সময় ঘরের ভেতর থাকার বিধান আছে। সবই অবশ্য শোনা কথা। সত্যি মিথ্যা জানি না।’
আমি হাসতে হাসতে বললাম, সত্যি হলে আমার জন্যে খুব মুশকিল। আমার অভ্যাস হল গভীর রাতে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করা।
বায়েজিদ সাহেব ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমি জানি। তবে আপনার জন্যে কোন সমস্যা নাই।
‘সমস্যা নেই কেন?’
‘আপনি সঠিক মানুষ।’
‘আমি সঠিক মানুষ আপনাকে কে বলল? রাত-বিরাতে রাস্তায় হাঁটলেই মানুষ সঠিক হয়ে যায়? তাহলে তো চোর পুলিশ সবচে’ বড় সঠিক।’
বায়েজিদ সাহেব আবার মাথা নিচু করে ফেললেন। সম্ভবত তিনি আর কথা বলবেন না। একদিনে বেশি কথা বলে ফেলেছেন। তাঁর সঙ্গে আমার কথা বলতে ভাল লাগছে। ভদ্রলোক দু’বছরের উপর আমার পাশের ঘরে আছ্নে। এই দু’বছরে তাঁর সঙ্গে আমার তিন চার বারের বেশি কথা হয়নি। সেই সব কথাও—‘কেমন আছেন বায়েজিদ সাহেব?’ ‘এই আছি।’ এর মধ্যে সীমাবদ্ধ ভদ্রলোক কি করেন, তাঁর দেশ কোথায়, তাঁর চোখ সবসময় টকটকে লাল কেন কিছুই জানি না।
‘বায়েজিদ সাহেব।’
‘জ্বি।’
‘কাল রাতে অনেকক্ষণ জেগেছিলাম। রেসকোর্সের ভেতরে হেঁটে হেঁটে দোজখের হাওয়া লাগাচ্ছিলাম। বৃষ্টি যখন শুরু হল তখন ঘরে এসেছি। এত সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গার কথা না। স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গেছে। স্বপ্নটা পুরোপুরি দেখতেও পারিনি। মনে হচ্ছিল দুঃস্বপ্ন। দেখতে ইচ্ছা করছিল না বলে দেখিনি। জেগে উঠেছি।’
বায়েজিদ সাহেব শান্ত গলায় বললেন, সুবেহ সাদেকের সময় আল্লাহপাক কাউকে দুঃস্বপ্ন দেখান না।
‘তাই না-কি?’
‘জ্বি। সুবেহ সাদেক কুব একটা ভাল সময়। এই সময় আল্লাহপাক মানুষকে মঙ্গলের কথা বলেন, আনন্দের কথা বলেন।’
‘এটাও কি মওলানার কাছ থেকে শোনা কথা?’
‘জ্বি-না, আমার স্ত্রীর কথা। সে জীবিত নেই। উনিশ বছর আগে মারা গেছে। আমার কন্যার জন্মের সময় মারা গেল। সে জীবিত থাকার সময় অদ্ভুদ অদ্ভুদ কথা বলত। তখন হাসাহাসি করতাম। এখন করি না। এখন তার সব কথাই সত্যি মনে হয়।’
‘বেহেশত এবং দোজখের জানালার কথাও কি তাঁর কথা?’
‘জ্বি।
‘আপনার স্ত্রীর মৃত্যুর পর আপনি আর বিয়ে করেন নি?’
‘জ্বি-না।
‘আপনার মেয়েটির বয়স তাহলে এখন উনিশ?’
‘জ্বি।
‘তাঁর কি বিয়ে হয়েছে?’
‘জ্বি-না।’
‘সে থাকে কোথায়?’
‘তার মামাদের কাছে থাকে। নিজের কাছে এনে রাখতে চেয়েছিলাম। সামর্থ্য হল না।অতি ছোট চাকরি করি । বেতন যা পাই তা দিয়ে ঢাকায় ঘর ভাড়া করে থাকা সম্ভব না।’
‘আমি আপনাকে অনেক ব্যক্তিগত প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে ফেললাম। কিছু মনে করবেন না।’
‘জ্বি-না। আমি কিছুই মনে করি নি। আমি খুব খুশি হয়েছি। অনেক দিন থেকে আপনার সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলাম। সাহসে কুলায়নি।’
‘আমাকে বলতে চাচ্ছিলেন কেন?’
‘আপনি মহাপুরুষ ধরণের মানুষ। আপনি আমার মেয়েটার জন্যে একটু প্রার্থনা করলে তার মঙ্গল হবে, এই জন্যে। মেয়েটার বিয়ে দিতে পারছি না। দুষ্ট লোকজন আমার মেয়েটার নামে বাজে একটা দুর্নাম ছড়িয়েছে। পুরো ব্যাপারটা যে মিথ্যা সবাই জানে, কেউ বিশ্বাস করে না, আবার সবাই বিশ্বাস করে। মেয়েটা খুব কষ্টে আছে ভাই সাহেব। আমি জানি, আপনি মেয়েটার কষ্ট কমাতে পারবেন। আমার মেয়েটা যে কত ভাল তা একমাত্র আমি জানি আর জানেন আল্লাহপাক। আপনার কাছে আমি হাতজোড় করছি।’
বায়েজিদ সাহেব সত্যি সত্যি হাতজোড় করলেন। আমি বিব্রত গলায় বললাম, ভাই, আপনি আমার হলুদ পাঞ্জাবি, লম্বা দাড়ি-গোঁফ দেখে বিভ্রান্ত হয়েছেন। আপনার দোষ নেই, অনেকেই হয়। বিশ্বাস করুন, আমি মহাপুরুষ না। অতি সাধারণ মানুষ।প্রচুর মিথ্যা কথা বলি, অনেক ধরণের ভড়ং করি। মানুষকে হকচকিয়ে দেয়ার একটা সচেতন চেষ্টা আমার মধ্যে থাকে। কাজকর্ম করার কোন ক্ষমতা নেই বলেই আমি ভবঘুরে। বুঝতে পারছেন?’
বায়েজিদ সাহেব আগের মত কোমল গলায় বললেন, আপনি একটু দোয়া করবেন আমার মেয়েটার জন্যে। অনেকদিন বলার চেষ্টা করেছি। সাহস পাইনি। আজ আল্লাহপাক সুযোগ করে দিয়েছেন।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, ঠিক আছে, প্রার্থনা করলাম। অসম্ভব রুপবান এবং ধনবান ছেলের সঙ্গে আপনার কন্যার বিয়ে হবে। তারা দু’জনে মিলে ঘুরবে দেশ থেকে দেশান্তরে।
বায়েজিদ সাহেব ক্ষীণ গলায় বললেন, আপনার অসীম শুকরিয়া।
আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মহাপুরুষদের মতেই গম্ভীর ভঙ্গিতে নিচে নেমে গেলাম। ভাল যন্ত্রনা হয়েছে। আমারেক অলৌকিক ক্ষমতাধর মনে করে এমন লোকের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে।একটা আশ্রম-টাশ্রম খুলে বসার সময় বোধহয় হয়ে এসেছে। কমন বাথরুম নিচে। এত ভোরে কেউ উঠেনি। বাথরুম খালি পাওয়া যাবে। কল ছেড়ে কিছুক্ষণ মাথা পেতে বসে থাকব। তারপর পর পর তিন কাপ চা খেতে হবে। রাতে ঘুম না হওয়ায় মাথা জাম হয়ে আছে। চা খেয়ে রফিকের বাসায় একবার যেতে হবে। সে গত এক সপ্তাহ ধরে দু’দিন পর পর আমার কাছে আসছে।
কখনো দেখা হচ্ছে না। সে এমন সময় আসে যখন আমি থাকি না। তার ব্যাপারটি কি, কে জানে?
বাথরুমের বেসিন অনেকদিন ধরেই ভাঙ্গা। আজ দেখি নতুন বেসিন। বেসিনের উপর নতুন আয়না। মেসের মালিক বসিরুদ্দিন সাহেব খরচের চুড়ান্ত করেছেন বলে মনে হচ্ছে। বেসিনের কাছে না গিয়েও বলতে পারছি কোন রিজেকটেড বেসিন বসিরুদ্দিন সাহেব কুঁড়িয়ে এনে ফিট করে দিয়েছেন। আয়নাটাও হবে ঢাকা শহরের সবচে সন্তা আয়না। মুখ দেখা যাওয়ার কোন কারণ নেই। আয়না দেখলেই আমার কাছে দাঁড়াতে ইচ্ছা করে। খুবই ক্ষুদ্র ইচ্ছা। এবং নির্দোষ ইচ্ছা। তবু অতি ক্ষুদ্র ইচ্ছাকে প্রশ্রয় দিতে নেই। একবার প্রশ্রয় দেয়া শুরু করলে সব ইচ্ছাকেই প্রশ্রয় দিতে মন চাইবে। ‘‘যে মানব সন্তান ক্ষুদ্র কামনা জয় করতে পারে সে বৃহৎ কামনাও জয় করতে পারে।’’ এই মহৎ বাণী আমার বাবার। চামড়ায় বাঁধানো তিনশ একুশ পৃষ্টার একটা খাতায় তিনি এইসব বাণী মু্ক্তার মত গোটা গোটা হরফে লিখে রেখে গেছেন। পুরো খাতাটাই হয়তো ভরে ফেলার ইচ্ছা ছিল। সময় পাননি। মাত্র চার দিনের নোটিসে তাঁকে পৃথিবী ছাড়তে হল। জ্বর হল। জ্বরের চতুর্থ দিনে বিস্ময় এবং দুঃখ নিয়ে তাঁকে বিদায় নিতে হল। আমাকে হতাশ গলায় বললেন, আসল কথা তোকে কিছুই বলা হল না। অল্প কিছু লিখেছি—এতে কিছুই হবে না। তিনি আঠারো পৃষ্টা পর্যন্ত লিখেছেন। কিছু কিছু বাণী লেখার পরও কেটে ফেলা হয়েছে, তাঁর পছন্দ হয়নি। বাণীল মধ্যেও ভেজাল আছে। এ রকম একটা ভেজাল বাণী হল:
‘‘হে মানব সন্তান, সুখের স্বরুপ নির্ধারণের চেষ্টা কর। যে সুখের স্বরুপ জেনেছে সে দুঃখ জেনেছে। দুঃখের বাস সুখের মাঝখানে।’’
এই বাণ লাল কালি দিয়ে কেটে তার নিচে বাবা লিখেছেন—ভাব অস্পষ্ট ও ধোঁয়াটে।
কলের নিচে মাথা পেতে মনে হল জগৎ সংসারে সবটাই কি অস্পষ্ট ও ধোঁয়াটে নয়? স্বপ্নকে আমরা অস্পষ্ট । বাস্তব কি স্বপ্নের চেয়েও অস্পষ্ট নয়?
শুধু মাথা ভেজানোর জন্যে গিয়েছিলাম, পুরো শরীর ভিজিয়ে ফেললাম। আরাম লাগছে। একটু শীত ভাব হচ্ছে—আরামদায়ক শীত ভাব। অর্থ্যাৎ আমি সুখ পাচ্ছি। এই সুখের স্বরুপ জানলেই দুঃখ কি তা জেনে ফেলব। ভেজাল বাণী তাই বলেছে। চোখ বন্ধ করে কলের নিচে মাথা পেতে আছি। সারাদিন এভাবে বসে থাকলে কেমন লাগবে। চোখ বন্ধ থাকায় বৃষ্টির মত লাগছে। মনে হচ্ছে আষাঢ় মাসের মুষল বর্ষণে গা পেতে আছি।
মেসের ঠিকা ঝি ময়নার মা’র কথা কানে না এলে কল্পনা আরো ফেনানো যেত। ময়নার মা চলে এসেছে। সে কথা না বলে এক মুহুর্ত থাকতে পারে না। আশেপাশে কেউ নেই বলে কথা বলছে বাসনগুলির সঙ্গে। মানুষের সঙ্গে কথা বললে তেমন কৌতুহলী হতাম না। বাসন কোসনের সঙ্গে কথা বলছে বলেই কৌতুহলী হয়ে শুনতে ইচ্ছা হচ্ছে। মানুষ শুধু যে প্রাণী জগতের সঙ্গেই সম্পর্ক স্থাপন করতে চায় তাই না, জড় জগতের সঙ্গেও চায়। ময়নার মা চাপা গলায় গভীর বেদনার সঙ্গে বলছে, চেপ্টা থালা। আমিও চেপ্টা, তুইও চেপ্টা। আমার চেপ্টা কপাল, তরও চেপ্টা কপাল। কান্দাভাঙা ডেকচি। তর যেমন কান্দাভাঙা, আমারও কান্দাভাঙা। তর কান্দা ভাঙছি আমি ময়নার মা। ক’দেহি আমার কান্দা কে ভাঙছে?
ময়নার মা’র কথা শোনার ইচ্ছা করছে, ক্ষুদ্র এবং নির্দোষ ইচ্ছা। এটা ঠিক হচ্ছে না। কলের পানি আরো জোরে ছাড়তে পারলে কাজ হতো। পানিতে আর জোর নেই। আমি বাথরুম থেকে বের হয়ে এলাম। ময়নার মা আমাকে দেখে লম্বা ঘোমটা দিল। ঘোমটার আড়াল থেকে বলল, আব্বার শইল ভাল? সে গোড়া থেকেই আব্বা ডাক ধরেছে। নিষেধে কাজ হয়নি।
‘ভাল। তুমি কেমন আছ, ময়নার মা?’
‘আমি হইলাম আফনের কান্দাভাঙা ডেগ। আফনের মাথার দরদ কমছে?’
‘কয়েকদিন হচ্ছে না।’
‘বদ্যি গেরামের একখান তেল আছে, মাথার দরদে খুব আরাম। আফনেরে আইন্যা দিমু।’
‘আচ্ছা দিও।’
‘দেশের বাড়িত কেউ নাই, যাওয়া পড়ে না। আফনের জইন্যে যামু।’
আমি চুপ করে রইলাম। আমার দিক থেকে কোন সাড়া পেলে সে কথা বলা থামাবে না।
‘মাথার দরদ ভাল জিনিস না। ময়নার বাবা মরল মাথার দরদে। ফাল্গুন মাসে আমার পরথম বলল, আইজ কাজে যামু না—মাথার মইদ্যে দরদ। আমি কইলাম এইটা কেমুন কথা? মাথার মইদ্যে দরদ হইছে বইল্যা কাম কামাই করবেন? যান কামে যান। তা ধরেন মানুষটা গেল…।
ময়নার মা’র এই গল্প আগেও কয়েকবার শোনা। আবারো শুনতে ইচ্ছা হচ্ছে। ভেজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে গল্প শুনছি। শুনতে মোটেও ইচ্ছা করছে না। গল্পটা আবার বলতে পেরে সে যতটা আনন্দ পাচ্ছে আমি ঠিক ততটাই বিরক্ত হচ্ছি। সব মিলে সমান সমান।
রফিকের কাছে যাব বলে ভেবেছিলাম তার প্রয়োজন হল না। ভেজা কাপড়ে দোতলায় উঠে দেখি রফিক বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। অত্যন্ত সুপুরষ একজন মানুষ। আমার ধারণা, সে ছেঁড়া শার্ট গায়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও তাকে রাজপু্ত্রের মত লাগবে। সে শেভ করেনি। মুখে খোচা দাড়ি। তার পরেও এত সুন্দর দেখাচ্ছে। আমি আনন্দিত গলায় বললাম, কি খবর রফিক?
রফিক একবার আমার দিকে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল। জবাব দিল না। চুপ করে রইল। প্রশ্ন করলে সে কখনো জবাব দেয় না। আগে কিছুটা দিত, ইদানীং একেবারেই দিচ্ছে না। ব্যাপারটা যত অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে আসলে তত অস্বাভাবিক না। প্রশ্ন করলে চুপ করে থাকার কারণ সে নিজেই ব্যাখ্যা করছে। সেই ব্যাখ্যা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য বলেই মনে হয়েছে। স্কুলে পড়ার সময় স্যারেরা তাকে প্রশ্ন করতেন, পড়া ধরতেন। সে যে উত্তরই দিত মার খেতে হত। মার থেতে থেতে প্রশ্নের উপরই তার এক ধরণের ভীতি জন্মে গেছে। প্রশ্ন করলে জবাব দেয় না, গম্ভীর হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে প্রশ্নের উত্তরে ফোঁস রে নিঃশ্বাস ফেলে। তার কাছে কিছ জানতে হলে এমনভাবে জিজ্ঞেস করতে হয় যেন কখনো প্রশ্ন বলে মনে হয় না।
‘দাঁড়া আমি কাপড় ছাড়ি। তারপর চা খেয়ে আসি। তুই কয়েকবার আমার খোঁজ করেছিস। ব্যাপার কি?’
রফিক চুপ করে রইল। চুপ করে থাকবে, জানা কথা। শেষের দিকে প্রশ্ন করা হয়েছে। আমি কাপড় ছাড়লাম। শার্ট-প্যান্ট পরতে পরতে বিরক্ত গলায় বললাম, কাঠের মত দাঁড়িয়ে থাকলে কোন লাভ হবে না। কিছু বলার থাকলে বলে ফেল।
‘তোর কোন মন্ত্রীর সাথে পরিচয় আছে?’
‘কেন?’
রফিক নিঃশ্বাস ফেলল। কিছু বলল না। আমি হতাশ গলায় বললাম, তুই যা বলার বলে যা।আমি নিজ থেকে কিছু জিজ্ঞেস করব না।
‘চাকরি চলে গেছে। সাসপেনশন অর্ডার হয়েছে।’
‘ও আচ্ছা।’
‘আমি কিছুই করি নি। সুপারিনটেনডেন্ট ইনজিনিয়ার এসেছিলেন। আমাকে প্রশ্ন করলেন্ আমি জবাব দিলাম না। উনি মনে করলেন আমি ইচ্ছা করে বেয়াদবী করছি।’
‘যারা তোকে চেনে, তোর সঙ্গে কাজ করে, তারা তো তোর স্বভাব-চরিত্র জানে। তারা কিছু বলল না? তারা জানে তোকে কিছু জিজ্ঞেস করলে তুই চুপ করে থাকিস।’
রফিক নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কেউ আমার পক্ষে কিছু বলে নি। আমার সাসপেনশন অর্ডার হওয়ায় সবাই খুশি। কেউ আমাকে দেখতে পারে না।’
‘তোকে দেখতে না পারার তো কোন কারণ নেই।’
‘আমাকে শো কজ করেছিল। শো কজের জবাব দিয়েছি। জবাব ওদের পছন্দ হয় নাই। সবাই বলেছে আমাকে ডিসমিস করে দেবে।’
‘শো কজে কি লিখেছিলি? কথা বল গাধা। তোকে প্রশ্ন করছি না—এম্নি জিজ্ঞেস করলাম।’
রফিক চুপ করে রইল। আমি বিরক্ত গলায় বললাম, ওদের কোন দোষ দিচ্ছি না। আমি তোর বস হলে অনেক আগেই ডিসমিস করে দিতাম। প্রশ্নের জবাব দে যাতে বুঝতে পারি ব্যাপারটা কি। শেষ প্রশ্ন।
‘কবে শো কজ করেছে? কবে জবাব দিয়েছিস?’
এক বাক্যে ডাবল প্রশ্ন। রফিক শুধু ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। আমি জবাবের জন্য অপেক্ষা করলাম না। চা খাবার জন্য রওনা হলাম। রফিক ক্ষীণ স্বরে বলল, অনেক আজেবাজে শো কজে লিখেছে—আমি নাকি কাজ জানি না, কাজের প্রতি আমার আগ্রহ নাই। ইনসাবর্ডিনেশন। মনটা খারাপ হয়েছে। তোর জানাশোনা মন্ত্রী আছে?’
এবার আমি চুপ করে রইলাম। চুপ করে থাকলে রফিক নিজেই বলবে। রফিক বলল, আমার এক খালাত ভাইয়ের আত্নীয় আছে মন্ত্রী। খালাতো ভাইকে বললে হয়। বলতে ইচ্ছা করে না। খালাতো ভাইটা বিরাট বদ। তুই কোন মন্ত্রী চিনিস না, তাই না? চেনার অবশ্য কথা না। ভাল মানুষদের সঙ্গে মন্ত্রীর পরিচয় থাকে না। বদগুলির সঙ্গে থাকে। খালাতো ভাইটা একটা বদ এই জন্যেই…।
রফিক কথা শেষ করল না। মাঝে মাঝে সে দীর্ঘ বাক্য শুরু করে। যেই মূহুর্তে মনে করে অনেক বেশি কথা বলা হয়ে গেল, সেই মুহুর্তে চুপ করে যায়। বাক্যটা শেষ পর্যন্ত করে না।
চায়ের টেবিলে দু’জন মুখোমুখি বসলাম। রফিক নাশতা করে এসেছে কি-না জিজ্ঞেস করা অর্থহীন। জবাব দেবে না। দু’জনের নাশতা দিতে বললেই ভাল।
‘রফিক, এই সপ্তাহেই তোদের বাড়িতে যাব। তোরা তো এখনো নারায়নগঞ্জ ড্রেজার কলোনিতে থাকিস? জবাব দিতে হবে না উপরে নিচে মাথা নাড়, তাহলে বুঝব।’
রফিক মাথা নাড়ল।
‘নদীর কাছে না তোদের বাড়ি?’
রফিক আবার মাথা নাড়ল।
‘তুই এক কাজ করতে পারবি—নদীল তীরে বালির ভেতর দু’টা গর্ত খুঁড়ে রাখতে পারবি? মানুষ-সমান গর্ত। যেন গর্তে ঢুকলে শুধু মাথাটা বের হয়ে থাকে। কাজটা করতে পূর্ণিমার আগের দিন।’
রফিক বিরস গলায় বলল, আচ্ছা।
গর্ত কেন খুঁড়তে হবে, কি ব্যাপার, কিছুই জিজ্ঞেস করল না। এই স্বভাবই তাঁর না। পূর্ণিমার আগের দিন তার বাড়িতে উপস্থিত হলে দেখা যাবে সে ঠিকই গর্ত খুঁড়ে বসে আছে।
পরোটা ভাজি দিয়ে গেছে। রফিক খাচ্ছে না। অর্থ্যাৎ সে বাড়ি থেকে নাশতা করে বের হয়েছে। ভোররাতে রওনা না হলে এত সকালে কেউ ঢাকায় পৌছতে পারে না। এত ভোরে কে তাকে নাশতা বানিয়ে দিয়েছে? তার বউ? বছর খানিক আগে রফিক বিয়ে করেছে। যতদুর জানি, মেয়েটা চমৎকার। আপন-পর বলে তার মধ্যে কিছু নেই। সবাই আপন। প্রচন্ড মাথা ব্যথা নিয়ে রফিকের কাছে গিয়েছি। তার স্ত্রীর সঙ্গে সেবারই প্রথম দেখা। সে রাগী গলায় বলল, মাথা ব্যথা করছে আমাকে বলেননি কেন? আমি মাথা ব্যথার এমন একটা ম্যাসেজ জানি দু’মিনিটে ব্যথা উধাও হবে। দেখি মাথা নিচু করুন তো। বৌ-এর সঙ্গে তার মিল হয়নি। বউ বেশিরভাগ সময়ই বাপের বাড়িতে থাকে। জিজ্ঞেস করলে জবাব দেবে না জানি, তবু জিজ্ঞেস করলাম, তোর বউ তোর সঙ্গে থাকে, না বাপের বাড়ি থাকে?
‘বাপের বাড়ি।’
‘আসে না তোর এখানে?’
‘আর আসবে না।’
রফিককে খুব চিন্তিত বা বিষাদগ্রস্ত মনে হল না। কখনো মনে হয় না। দুঃখিত বা বিষাদগ্রস্ত হবার ক্ষমতা সম্ভবত তার নেই। আমি সিগারেট ধরালাম। রফিকের দিকে প্যাকেট বাড়িয়ে দিতেই সে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সিগারেট খাই না। বউ পছন্দ করে না। তোর চেনা মন্ত্রী নাই? মন্ত্রী ছাড়া কিছুই হবে না।
আমি হালকা গলায় বললাম, একজন মন্ত্রীকে আমি খুব সামান্য চিনি। জহিরের বাবা। জহির আমার সঙ্গে স্কুল পড়ত। দেখি উনাকে বলে কোন ব্যবস্থা করা যায় কি-না। চিন্তা করিস না।
‘আমি চিন্তা করি না।’
‘তবে সমস্যা কি জানিস—আমি একটা কোন কথা বললেই তো মন্ত্রী শুনবে না। তিনি যেন মন দিয়ে আমার কথা শুনেন সেই ব্যবস্থা করতে হবে। আরেক কাপ চা খাবি?’
রফিক জবাব দিল না। মাথা নিচু করে বসে রইল। সে মনে হল আরো সুন্দর হয়েছে। বসে আছে কেমন হতাশ ভঙ্গিতে। বড় মায়া লাগছে। রফিকের সঙ্গে আমার পরিচয় কলেজে ওঠার পর। কোন একটা সমস্যা হলেই সে আমার কাছে এসে সমস্যাটা বলে নিশ্চিত হয়ে যায়। এখন সে বাড়ি যাবে পুরোপুরি চিন্তামু্ক্ত হয়ে। পঞ্জিকা দেখে পূর্ণিমার দিন গর্ত খুঁড়ে অপেক্ষা করবে আমার জন্যে। কোন কারণে সেদিন ঝড়বৃষ্টি হলেও সে দমবে না। তার এই আনুগত্য আমার একার প্রতি না, সবার প্রতি। এ ধরণের অন্ধ আনুগত্য শুধু পশুদের দেখা যায়। রফিক পশু না, মানুষ। বুদ্ধিমান সৎ ভালমানুষ ধরণের মানুষ। এমন সুন্দর একজন মানুষ যে দেখলেই মনে হয় প্রকৃতি তার এই সৌন্দর্য কোন এক বিশেষ উদ্দেশ্যে তৈরী করেছে। সেই উদ্দেশ্য কি কে জানে?
‘রফিক।’
‘হুঁ।’
‘তোর মা’র শরীর আশা করি ভালই আছে।’
‘বেশি ভাল না। শিগ্গির মারা যাবেন।কিছু খেতে পারেন না। খুব-না-কি গরম লাগে। সারাক্ষণ তালপাখা পানিতে ভিজিয়ে সেই পাখায় হাওয়া করতে হয়। ফ্যানের হাওয়া সহ্য হয় না।’
‘হাওয়া কে করে? তুই?’
রফিক আমার দিকে তাকাল। কিছু বলল না, পর পর দুটি প্রশ্ন করা হয়ে গেছে। তার জবাব দেবার কথা না।
রফিক একবার আমার দিকে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল। জবাব দিল না। চুপ করে রইল। প্রশ্ন করলে সে কখনো জবাব দেয় না। আগে কিছুটা দিত, ইদানীং একেবারেই দিচ্ছে না। ব্যাপারটা যত অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে আসলে তত অস্বাভাবিক না। প্রশ্ন করলে চুপ করে থাকার কারণ সে নিজেই ব্যাখ্যা করছে। সেই ব্যাখ্যা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য বলেই মনে হয়েছে। স্কুলে পড়ার সময় স্যারেরা তাকে প্রশ্ন করতেন, পড়া ধরতেন। সে যে উত্তরই দিত মার খেতে হত। মার থেতে থেতে প্রশ্নের উপরই তার এক ধরণের ভীতি জন্মে গেছে। প্রশ্ন করলে জবাব দেয় না, গম্ভীর হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে প্রশ্নের উত্তরে ফোঁস রে নিঃশ্বাস ফেলে। তার কাছে কিছ জানতে হলে এমনভাবে জিজ্ঞেস করতে হয় যেন কখনো প্রশ্ন বলে মনে হয় না।
‘দাঁড়া আমি কাপড় ছাড়ি। তারপর চা খেয়ে আসি। তুই কয়েকবার আমার খোঁজ করেছিস। ব্যাপার কি?’
রফিক চুপ করে রইল। চুপ করে থাকবে, জানা কথা। শেষের দিকে প্রশ্ন করা হয়েছে। আমি কাপড় ছাড়লাম। শার্ট-প্যান্ট পরতে পরতে বিরক্ত গলায় বললাম, কাঠের মত দাঁড়িয়ে থাকলে কোন লাভ হবে না। কিছু বলার থাকলে বলে ফেল।
‘তোর কোন মন্ত্রীর সাথে পরিচয় আছে?’
‘কেন?’
রফিক নিঃশ্বাস ফেলল। কিছু বলল না। আমি হতাশ গলায় বললাম, তুই যা বলার বলে যা।আমি নিজ থেকে কিছু জিজ্ঞেস করব না।
‘চাকরি চলে গেছে। সাসপেনশন অর্ডার হয়েছে।’
‘ও আচ্ছা।’
‘আমি কিছুই করি নি। সুপারিনটেনডেন্ট ইনজিনিয়ার এসেছিলেন। আমাকে প্রশ্ন করলেন্ আমি জবাব দিলাম না। উনি মনে করলেন আমি ইচ্ছা করে বেয়াদবী করছি।’
‘যারা তোকে চেনে, তোর সঙ্গে কাজ করে, তারা তো তোর স্বভাব-চরিত্র জানে। তারা কিছু বলল না? তারা জানে তোকে কিছু জিজ্ঞেস করলে তুই চুপ করে থাকিস।’
রফিক নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কেউ আমার পক্ষে কিছু বলে নি। আমার সাসপেনশন অর্ডার হওয়ায় সবাই খুশি। কেউ আমাকে দেখতে পারে না।’
‘তোকে দেখতে না পারার তো কোন কারণ নেই।’
‘আমাকে শো কজ করেছিল। শো কজের জবাব দিয়েছি। জবাব ওদের পছন্দ হয় নাই। সবাই বলেছে আমাকে ডিসমিস করে দেবে।’
‘শো কজে কি লিখেছিলি? কথা বল গাধা। তোকে প্রশ্ন করছি না—এম্নি জিজ্ঞেস করলাম।’
রফিক চুপ করে রইল। আমি বিরক্ত গলায় বললাম, ওদের কোন দোষ দিচ্ছি না। আমি তোর বস হলে অনেক আগেই ডিসমিস করে দিতাম। প্রশ্নের জবাব দে যাতে বুঝতে পারি ব্যাপারটা কি। শেষ প্রশ্ন।
‘কবে শো কজ করেছে? কবে জবাব দিয়েছিস?’
এক বাক্যে ডাবল প্রশ্ন। রফিক শুধু ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল। আমি জবাবের জন্য অপেক্ষা করলাম না। চা খাবার জন্য রওনা হলাম। রফিক ক্ষীণ স্বরে বলল, অনেক আজেবাজে শো কজে লিখেছে—আমি নাকি কাজ জানি না, কাজের প্রতি আমার আগ্রহ নাই। ইনসাবর্ডিনেশন। মনটা খারাপ হয়েছে। তোর জানাশোনা মন্ত্রী আছে?’
এবার আমি চুপ করে রইলাম। চুপ করে থাকলে রফিক নিজেই বলবে। রফিক বলল, আমার এক খালাত ভাইয়ের আত্নীয় আছে মন্ত্রী। খালাতো ভাইকে বললে হয়। বলতে ইচ্ছা করে না। খালাতো ভাইটা বিরাট বদ। তুই কোন মন্ত্রী চিনিস না, তাই না? চেনার অবশ্য কথা না। ভাল মানুষদের সঙ্গে মন্ত্রীর পরিচয় থাকে না। বদগুলির সঙ্গে থাকে। খালাতো ভাইটা একটা বদ এই জন্যেই…।
রফিক কথা শেষ করল না। মাঝে মাঝে সে দীর্ঘ বাক্য শুরু করে। যেই মূহুর্তে মনে করে অনেক বেশি কথা বলা হয়ে গেল, সেই মুহুর্তে চুপ করে যায়। বাক্যটা শেষ পর্যন্ত করে না।
চায়ের টেবিলে দু’জন মুখোমুখি বসলাম। রফিক নাশতা করে এসেছে কি-না জিজ্ঞেস করা অর্থহীন। জবাব দেবে না। দু’জনের নাশতা দিতে বললেই ভাল।
‘রফিক, এই সপ্তাহেই তোদের বাড়িতে যাব। তোরা তো এখনো নারায়নগঞ্জ ড্রেজার কলোনিতে থাকিস? জবাব দিতে হবে না উপরে নিচে মাথা নাড়, তাহলে বুঝব।’
রফিক মাথা নাড়ল।
‘নদীর কাছে না তোদের বাড়ি?’
রফিক আবার মাথা নাড়ল।
‘তুই এক কাজ করতে পারবি—নদীল তীরে বালির ভেতর দু’টা গর্ত খুঁড়ে রাখতে পারবি? মানুষ-সমান গর্ত। যেন গর্তে ঢুকলে শুধু মাথাটা বের হয়ে থাকে। কাজটা করতে পূর্ণিমার আগের দিন।’
রফিক বিরস গলায় বলল, আচ্ছা।
গর্ত কেন খুঁড়তে হবে, কি ব্যাপার, কিছুই জিজ্ঞেস করল না। এই স্বভাবই তাঁর না। পূর্ণিমার আগের দিন তার বাড়িতে উপস্থিত হলে দেখা যাবে সে ঠিকই গর্ত খুঁড়ে বসে আছে।
পরোটা ভাজি দিয়ে গেছে। রফিক খাচ্ছে না। অর্থ্যাৎ সে বাড়ি থেকে নাশতা করে বের হয়েছে। ভোররাতে রওনা না হলে এত সকালে কেউ ঢাকায় পৌছতে পারে না। এত ভোরে কে তাকে নাশতা বানিয়ে দিয়েছে? তার বউ? বছর খানিক আগে রফিক বিয়ে করেছে। যতদুর জানি, মেয়েটা চমৎকার। আপন-পর বলে তার মধ্যে কিছু নেই। সবাই আপন। প্রচন্ড মাথা ব্যথা নিয়ে রফিকের কাছে গিয়েছি। তার স্ত্রীর সঙ্গে সেবারই প্রথম দেখা। সে রাগী গলায় বলল, মাথা ব্যথা করছে আমাকে বলেননি কেন? আমি মাথা ব্যথার এমন একটা ম্যাসেজ জানি দু’মিনিটে ব্যথা উধাও হবে। দেখি মাথা নিচু করুন তো। বৌ-এর সঙ্গে তার মিল হয়নি। বউ বেশিরভাগ সময়ই বাপের বাড়িতে থাকে। জিজ্ঞেস করলে জবাব দেবে না জানি, তবু জিজ্ঞেস করলাম, তোর বউ তোর সঙ্গে থাকে, না বাপের বাড়ি থাকে?
‘বাপের বাড়ি।’
‘আসে না তোর এখানে?’
‘আর আসবে না।’
রফিককে খুব চিন্তিত বা বিষাদগ্রস্ত মনে হল না। কখনো মনে হয় না। দুঃখিত বা বিষাদগ্রস্ত হবার ক্ষমতা সম্ভবত তার নেই। আমি সিগারেট ধরালাম। রফিকের দিকে প্যাকেট বাড়িয়ে দিতেই সে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সিগারেট খাই না। বউ পছন্দ করে না। তোর চেনা মন্ত্রী নাই? মন্ত্রী ছাড়া কিছুই হবে না।
আমি হালকা গলায় বললাম, একজন মন্ত্রীকে আমি খুব সামান্য চিনি। জহিরের বাবা। জহির আমার সঙ্গে স্কুল পড়ত। দেখি উনাকে বলে কোন ব্যবস্থা করা যায় কি-না। চিন্তা করিস না।
‘আমি চিন্তা করি না।’
‘তবে সমস্যা কি জানিস—আমি একটা কোন কথা বললেই তো মন্ত্রী শুনবে না। তিনি যেন মন দিয়ে আমার কথা শুনেন সেই ব্যবস্থা করতে হবে। আরেক কাপ চা খাবি?’
রফিক জবাব দিল না। মাথা নিচু করে বসে রইল। সে মনে হল আরো সুন্দর হয়েছে। বসে আছে কেমন হতাশ ভঙ্গিতে। বড় মায়া লাগছে। রফিকের সঙ্গে আমার পরিচয় কলেজে ওঠার পর। কোন একটা সমস্যা হলেই সে আমার কাছে এসে সমস্যাটা বলে নিশ্চিত হয়ে যায়। এখন সে বাড়ি যাবে পুরোপুরি চিন্তামু্ক্ত হয়ে। পঞ্জিকা দেখে পূর্ণিমার দিন গর্ত খুঁড়ে অপেক্ষা করবে আমার জন্যে। কোন কারণে সেদিন ঝড়বৃষ্টি হলেও সে দমবে না। তার এই আনুগত্য আমার একার প্রতি না, সবার প্রতি। এ ধরণের অন্ধ আনুগত্য শুধু পশুদের দেখা যায়। রফিক পশু না, মানুষ। বুদ্ধিমান সৎ ভালমানুষ ধরণের মানুষ। এমন সুন্দর একজন মানুষ যে দেখলেই মনে হয় প্রকৃতি তার এই সৌন্দর্য কোন এক বিশেষ উদ্দেশ্যে তৈরী করেছে। সেই উদ্দেশ্য কি কে জানে?
‘রফিক।’
‘হুঁ।’
‘তোর মা’র শরীর আশা করি ভালই আছে।’
‘বেশি ভাল না। শিগ্গির মারা যাবেন।কিছু খেতে পারেন না। খুব-না-কি গরম লাগে। সারাক্ষণ তালপাখা পানিতে ভিজিয়ে সেই পাখায় হাওয়া করতে হয়। ফ্যানের হাওয়া সহ্য হয় না।’
‘হাওয়া কে করে? তুই?’
রফিক আমার দিকে তাকাল। কিছু বলল না, পর পর দুটি প্রশ্ন করা হয়ে গেছে। তার জবাব দেবার কথা না।
0 Response to " "
Post a Comment