Search Any Post...

সাতদিন পর ঢাকায় ফিরলাম। মানুষের মাথার চুল সাতদিনে ১.৫ মিলিমিটার বাড়ে। দাড়ি, গোঁফ এবং ভুরুর চুলও একই হারে বাড়ার কথা। ব্যাপার মনে হচ্ছে তা না। সাতদিনে আমার দাড়ি-গোঁফ কিছু গজিয়েছে। মাথার চুল তেমন গজায়নি। ভুরুর চুলের বৃদ্ধি সর্বনিম্ন পর্যায়ে। আগে যা ছিল এখনো তাই। আমার চেহারায় এক ধরণের ভৌতিক ভাব চলে এসেছে। ভৌতিক ভাবের জন্যে গায়ের চাদরও বোধহয খানিকটা দায়ী।
চেহারায় ভৌতিক ভাব সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছি গত রাতে। স্টিমারে করে ফিরছি। ফার্স্টক্লাসের ডেক কেমন দেখার জন্যে উকি দিলাম। ডেক ফাঁকা। অল্পবয়েসী এক মা তার বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে আছে। বাচ্চাটা হাত-পা ছুঁড়ছে এবং বিকট চিৎকার করছে। বাচ্চার বাবা বিব্রত মুখে এক গ্লাস পানি হাতে পাশে দাঁড়ানো। আমাকে দেখে বাচ্চা চোখ তুলে তাকাল। আর ঠিক তখন বাচ্চার মা নিচু গলায় বলল, ‘‘চুপ কর সোনা। চুপ না করলে ঐ ভূত তোকে খেয়ে ফেলবে।’’
বাচ্চা চুপ করে গেল। আতংকগ্রস্ত হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল। আমি কাছে এগিয়ে গেলাম, এবং গম্ভীর গলায় বললাম, আমি স্টিমারের দোতলায় আছি—বাচ্চা কান্নাকাটি করলে খবর দেবেন, এসে ভয় দেখিয়ে যাব। বাচ্চার মা লজ্জিত মুখে বলল, সরি সরি। কিছু মনে করবেন না।
‘না কিছু মনে করি নি। আপনার বাচ্চা যথেষ্ট ভয় পেয়েছে কি-না দেখুন। প্রয়োজন মনে করলে আরো খানিকটা ভয় দেখিয়ে যাই।’
মেয়েটির মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেল। মেয়েটা দেখতে খানিকটা রুপার মত।
ইচ্ছা করছিল আরো খানিকক্ষণ থাকি—সম্ভব হল না। বাচ্চাটা বেশি ভয় পেয়েছে। ভয়ে হাত-পা শক্ত হয়ে গেছে। আমাকে যে ভয়াবহ দেখাচ্ছে তার আরো প্রমাণ পেলাম। সেকেন্ড ক্লাসে অন্য একটি বাচ্চা, তিন চার বছর বয়স হবে, আমাকে দেখেই কাঁদতে শুরু করল। এই বাচ্চাটি ছিল বাবার কোলে। সেই ভদ্রলোক বিব্রত গলায় বলতে লাগল—আহা, উনি কিছু করবেন না তো। কিচ্ছু করবেন না।
বড় ফুপুর বাড়িতে এমন চেহারা নিয়ে উঠা ঠিক হবে না জেনেও উঠলাম। এই বাড়ির বাথরুম খুব সুন্দর । হালাকা নীল রঙের শ্রীলংকা টালি বসানো বাথরুম। বড় একটা বাথটাব আছে। বাথটাব পানি ভর্তি করে শুধু নাকটা ভাসিয়ে শুয়ে থাকা দারুন ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। তবে ও বাড়িতে উপস্থিত হবার বেশ ‍কিছু সমস্যা আছে।বড়ফুপু ঘোষনা করে দিয়েছেন, আমাকে যেন তাঁর বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁসতে দেয়া না হয়। আমি একটি পাবলিক ন্যুইসেন্স। আমার আসল স্থান—মানসিক রুগীদের জন্যে নির্ধারিত কোন হোম। হোমে জায়গা পাওয়া না গেলে সেকেন্ড চয়েস মীরপুর চিড়িয়াখানা। আমার ফুপু তাঁর স্বামীর কোন বক্তব্যের্ সঙ্গে একমত হন না, শুধু এই বক্তব্যে একমত। ফুপার বাড়িতে তারপরও মাসে দু’মাসে একবার যাই। ফুপার দুই ছেলেমেয়ে বাদল এবং রিনকি—এই দু’জনের কারণে। দু’জনই আমার মহাভক্ত। বাদলের ধারণা, আমি রাসপুটিন এবং গৌতম বুদ্ধের ফিফটি-ফিফটি মিকচার। শুধু মহাপুরুষ না, পরমপুরুষ। লোকজন এখনো আমাকে চিনতে পারছে না। যেদিন চিনবে, হৈ চৈ পড়ে যাবে। আমার সম্পর্কে রিনকির ধারণা অবশ্যি এত উচ্চ না। মেয়েরা সহজে কাউকে মহাপুরুষ ভাবে না। পুরুষের দুর্বল দিকগুলি সম্পর্কে তারা সবচে’ ভাল জানে বলেই তারা অনায়াসে মহাপুরুষকেও সাধারণ পুরুষের দলে ফেলে দেয়।
বাদল বসার ঘরে খবরের কাগজ পড়ছিল। আমাকে দেখে লাফ দিয়ে উঠল। আনন্দিত স্বরে বলল, আরে হিমুদা! কি যে সুন্দর তোমাকে লাগছে! অদ্ভুদ!
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, আছিস কেমন?
বাদল সামাজিক সৌজন্যের ধার দিয়েও গেল না। মুগ্ধ স্বরে বলল, ভুরুও কামিয়ে ফেলেছ? ইস কি অদ্ভুত! ভুরু কামানো মানুষ এই প্রথম দেখলাম। সাদা চাদরে কি অপূর্বই না তোমাকে লাগছে হিমুদা।
‘বাসায় লোকজন আছে?’
‘সবাই আছে। দাঁড়াও ডাকছি। তুমি এক কাজ কর—সন্ন্যাসীদের মত সোফায় পদ্মাসন হয়ে বস। আমি সবাইকে ডাকি। বাবাও বাড়িতে আছেন, অফিসে যান নি। তাঁর পেটে ব্যথা।’
‘তাহলে তো সমস্যা হয়ে গেল বাদল। পিস্তল বের করে আমাকে গুলি-টুলি করে দেয় কি-না কে জানে।’
‘গুলি করবে কেন শুধু শুধু। আর যদি করেও তোমার কিচ্ছু হবে না। রাসপুটিনকে তিনবার গুলি করা হয়েছিল, পটাসিয়াম সায়ানাইড খাওয়ানো হয়েছিল, নদীর পানিতে চেপে ধরা হয়েছিল…তারপরেও…’
বাদলের কথা শেষ হবার আগেই ফুপু ঢুকলেন। আমাকে দেখে শুরুতে হকচকিয়ে গেলেও চট করে নিজেকে সামলে নিলেন। পাথর হয়ে গেলেন। কর্কশ গলায় বললেন, তুই!
বাদল বলল, হিমুদাকে গ্রাণ্ড দেখাচ্ছে দেখলে মা? উফ অপূর্ব!
ফুপুর গম্ভীল গলায় বললেন, এই নতুন ভং কবে ধরলি?
আমি মধুর ভঙ্গিতে হাসলাম। ফূপু বললেন, তোকে না এ বাড়িতে আসতে নিষেধ করা হয়েছে। কি মনে করে এলি?
‘গোসল করতে এসেছি ফুপু। গোসল করেই বিদেয় হব। বাথটাবে সারা শরীর ডুবিয়ে…’
‘পাগলের মত কথা বলিস না। তোকে আমাদের বাথরুমে ঢুকতে দেব?’
বাদল বলল, অফকোর্স দেবে মা। আমি বাথটাবে পানি দিচ্ছি। ডিপ ফ্রীজে বরফ আছে মা? বাথটাবে বরফের টুকরা ছেড়ে দেব। গ্রাণ্ড হবে।
ফুপুর ক্রুদ্ধ গলায় বললেন তুই আমার সামনে থেকে যা বাদল, হিমুর সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
‘তুমি কথা বলতে থাক। আমি বাথটাব রেডি করি। বাথটাবটা আরেকটু বড় হলে আমিও তোমার সঙ্গে গোসল করে ফেলতাম।’
বাদল অত্যন্ত ব্যস্ত ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকে গেল। ফুপু বললেনে, তোকে যে পুলিশ খুঁজছে এটা তুই জানিস?
‘না। আমি ঢাকায় ছিলাম না।’
‘পুলিশ আমাদের এখানেও রোজ একবার করে তোর খোঁজে টেলিফোন করে।
তুই না-কি কোন মন্ত্রীর ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে গেছিস?’
‘জ্বালানী মন্ত্রীর ছেলে?’
‘কোন মন্ত্রী জানি না, তোর ফুপা জানে। সত্যি কিনা বল?’
‘না।’
‘না হলে খামাখা তোকে পুলিশ খুঁজবে কেন?’
‘পুলিশ তো খামাখাই খোঁজাখুঁজি করে ফুপু।’
‘তুই তোর ফুপার ঘরে যা। তার সঙ্গে কথা বল। কথা বলে বিদেয় হয়ে যা। এক মুহূর্তও এখানে থাকবি না।’
‘গোসল করে ভদ্র হয়ে গেলে কেমন হয়?’
‘এই বাড়িতে তোর গোসল হবে না। এক কথা কতবার বলল? যা, তোর ফুপার ঘরে যা।’
ফুপা বিছানায় কাত হয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন। টেবিলে বিরাট এক গ্লাস ভর্তি ঘোলাটে রঙের বস্তু। আমি ঘরে ঢুকেই বললাম, ওরস্যালাইন চালাচ্ছেন না-কি ফুপা?
ফুপা তিক্ত গলায় বললেন, ওরস্যালাইনা না। ডাবের পানি।
‘পেটব্যথা কমেছে কিছূ?’
‘আমার শরীর সম্পর্কে তোমার কৌতুহল দেখানোর কোন কারণ দেখছি না।’
‘ফূপু বলছিল আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চান।’
‘আমি কারো সঙ্গে কথা বলতে চাই না। তোমার সঙ্গে তো নয়ই।’
‘তাহলে ফুপা যাই?’
‘না বোস। তোমার ফুপু কি বলেছে যে পুলিশ তোমাকে খুঁজছে?’
‘জ্বি, বলেছেন।’
‘মন্ত্রীর ছেলেকে নিয়ে না-কি ভেগেছ? করেছ কি? খুন করেছ?’
‘না।’
‘এখন না করলেও করবে। You will up in murder. তুমি এক্ষুণি মন্ত্রীর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ কর। এবং পুলিশকে বল আর যেন তারা টেলিফোন করে আমাকে বিরক্ত না করে।’
‘আচ্ছা বলব। আমি কি এখন উঠতে পারি ফুপা?’
‘হ্যাঁ উঠতে পার। আমি তোমাকে এ বাড়িতে আসতে নিষেধ করেছিলাম , তারপরেও এসেছ?’
‘গোসল করার জন্যে এসেছি। গোসল করেই চলে যাব।’
‘গোসলের জন্যে বাথরুম খোঁজা তোমার শোভা পায় না হিমু্। ‍তুমি গোসল করবে ডোবায়, নর্মায়। মানুষ স্নান করে পরিষ্কার হবার জন্যে, তুমি কর অপরিষ্কার হবার জন্যে। ভুল বললাম?’
আমি জবাব দিলাম না। ফুপাকে শান্ত করার একটা উপায় হচ্ছে তাঁর কোন প্রশ্নের জবাব না দেয়া। কথা বলতে বলতে তিনি এক সময় ক্লান্ত হয়ে চুপ করে যান।
‘হিমু!’
‘জ্বি।’
‘তুমি নিজে একটা বদ্ধ উন্মাদ। তোমার দেখাদেখি আমার ছেলেটাও উন্মাদ হচ্ছে। মানুষ ভালটা কখনো শেখে না, মন্দটা শেখে। এই যে তুমি দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে বিতিকিচ্ছিরি কান্ড করেছ—বাদল এই দেখে উৎসাহী হবে।আমি তোমার সঙ্গে একশ টাকা বাজি রাখতে পারি। আজ সন্ধ্যার মধ্যেই সে মাথা মুড়িয়ে ফেলবে। রাখতে চাও বাজি?’
‘জ্বি না।’
‘রাখতে চাও না কেন? টাকা নেই?’
‘টাকার সমস্যা তো আছেই, তা ছাড়া এ বাজিতে আপনার জিতে যাবার সম্ভাবনা। আমারো ধারণা, বাদল মাথা মুড়িয়ে ফেলবে, ভুরু কামিয়ে ফেলবে।’
ফুপা বিস্মিত হয়ে বললেন, ভুরু কামাবে কেন?’
‘আমি ভুরু কামিয়েছি তো, তাই।’
‘তুমি ভুরু কামিয়েছ!’
‘জ্বি।’
‘I see. হিমু।’
‘জ্বি।’
‘আমি তোমাকে একটা প্রপোজাল দিচ্ছি। মন ‍দিয়ে শোন। দিনে দশ টাকা হিসেবে প্রতি মাসে আমি তোমাকে তিনশ করে টাকা দেব। তার বদলে তুমি এ বাড়িতে আসবে না। রাজি আছ?’
‘ভেবে দেখি।’
‘আচ্ছা যাও ফাইভ হানড্রেড। প্রতি মাসের এক তারিখে আমি নিজে গিয়ে টাকাটা তোমার হাতে দিয়ে আসব। বাট ইউ গট টু প্রমিজ যে এই বাড়ির দু’হাজার গজের ভেতর তোমাকে দেখা যাবে না।’
‘ঠিক আছে।’
‘তুমি তাহলে রাজি?’
‘জ্বি রাজি।’
‘প্রতিজ্ঞা করছ?’
‘করছি।’
‘আজ হচ্ছে মাসের কুড়ি তারিখ। তুমি দশদিনের টাকা পাবে। মাসে পাঁচশ হলে দশ দিনে হল ১৬৬ টাকা ৬৬ পয়সা।’
ফুপা মানিব্যাগ বের করলেন। টাকা বের করার আগেই বাদল ঢুকল। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, ত্রিশটা টাকা দাও তো বাবা।
‘কেন?’
‘দুই কেজি বরফ আনব। দশ টাকা করে কেজি। দশটাকা রিকসা ভাড়া।’
‘কেন?’
‘হিমুদা গোসল করবে। দুই কেজি বরফ এনে ছেড়ে দেব। ডিপ ফ্রীজে একদানা বরফ নেই।’
ফুপা কোন কথা না বলে বাদলে হাতে ত্রিশটা টাকা দিলেন এবং গভীর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি অত্যন্ত চিন্তিত।
‘হিমু।’
‘জ্বি।’
‘কে বলবে তোমার সঙ্গে মেশার আগে আমার এই ছেলে বুদ্ধিমান ছিল?’
‘বুদ্ধি এখনো আছে ফুপা।’
ফুপা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। বিড় বিড় করে বললেন, মানুষের ব্রেইন পুরোপুরি অকেজো করে দেয়ার ক্ষমতা কোন সহজ ক্ষমতা না। সবাই পারে না। তুমি পার।
‘ওর ব্রেইন নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না ফুপা। ওর ব্রেইন ভাল।’
‘ব্রেইন ভাল? ব্রেইন ভালর নমুনা শুনবে? গতমাসে কি করল শোন—বাড়ির পেছনে একটা সজনে গাছ আছে না? এক সন্ধ্যে বেলা দেখি সজনে গাছ জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বারান্দা থেকে দেখলাম। নিচে নেমে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপার কি? সে দাঁত বের করে বলল, গাছের ইলেকট্রন নিয়ে নিচ্ছি। আমি বললাম, গাছের ইলেকট্রন নিয়ে নিচ্ছিস মানে? গাছের ইলেকট্রন নিতে তোকে কে বলেছে? সে চোখ বড় বড় করে বলল—হিমুদা শিখিয়েছে।এই ছেলের ব্রেইন তুমি ভাল বলবে?
আমি তো তোমার কোন ক্ষতি করিনি। তুমি কেন আমার এত বড় ক্ষতি করছ?’
আমি অস্বস্তির সঙ্গে বললাম, গাছের ইলেকট্রন নেয়ার ব্যাপারটা আপনাকে আরেকদিন বুঝিয়ে বলব। একবার বুঝিয়ে বললে আপনার কাছে আর তেমন হাস্যকর লাগবে না।
‘আমাকে কিছুই বুঝিয়ে বলতে হবে না। ‍তুমি বিদেয় হও। পাঁচশ টাকা দিচ্ছি, খুশি হয়েই দিচ্ছি। নিয়ে উধাও হয়ে যাও। দয়া করে বাদল বরফ নিয়ে ফিরে আসার আগেই যাও। ওর সঙ্গে আরো কিছুক্ষণ থাকলে—তোমার কাছ থেকে আরো কিছু কায়দা কানুন শিখে ফেলবে। এখন গাছ থেকে ইলেকট্রন নিচ্ছে, পরে হয়তো আগুন থেকে ইলেকট্রন নিতে চাইবে। একটাই আমার ছেলে হিমু…ওনলি সান।’
‘ঠিক আছে ফুপা আমি যাচ্ছি।’
‘থ্যাংকস। মন্ত্রীর ছেলের ব্যাপারটা খোঁজ নিও। ওরা বড় বিরক্ত করছে।’
‘আচ্ছা খোঁজ নেব।’
‘ওসিকে বলবে আর যেন আমাকে বিরক্ত না করে। এক্ষুনি টেলিফোন করে বলে দাও—টেলিফোন নাম্বার তোমার ফুপুর কাছে আছে?’
‘আছে ফূপা, এক্ষুণি টেলিফোন করছি।’
‘এখান থেকে টেলিফোন করার দরকার নেই। কোন দোকান-টোকান থেকে কর। নাও, টেলিফোনের জন্যে পাঁচটা টাকা নিয়ে যাও।’
গোসল না করেই ফুপার ঘর থেকে বের হলাম। ডাক্তারখানা থেকে ওসি সাহেব কে টেলিফোন করলাম। ভদ্রলোক হাতে আকাশের চাঁদ পেলেন বলে মনে হল। আনন্দে খানিকক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। তা তো করে তোতলালেন।
‘কে বলছেন, হিমু সাহেব? ও মাই গড। আপনাকে আমরা পাগলের মত খুঁজছি। আপনি আত্মীয়স্বজনের যে লিস্ট দিয়ে গিয়েছিলেন সেই লিস্ট ধরে ধরে সবার কাছে গিয়েছি। যাদের টেলিফোন নাম্বার আছে তাদের অনবরত টেলিফোন করছি।’
‘কেন বলুন তো?’
‘বিরাট সমস্যা হয়েছে ভাই। মোবারক হোসেন সাহেবের ছেলে—ঐ যে আপনার বন্ধু জহির—ও বাড়ি থেকে পালিয়েছে। পাওয়া যাচ্ছে না। মোবারক সাহেবের ধারণা, আপনি তাকে ফুসলে-ফাসলে নিয়ে গেছেন, কিংবা আপনি জানেন সে কোথায় আছে।’
‘আমি জানি না।’
‘ভাই, আপনি জানেন কিংবা না জানেন, মোবারক হোসেন সাহেবের সঙ্গে আপনাকে একটু দেখা করতে হবে। এক্ষুণি।’
‘এক্ষুণি তো যেতে পারব না। আমার এখনো গোসল হয় নি।’
‘ভাই আমি সামান্য ওসি। ছোট চাকরি করি। আপনারা দু’জন এসে আমাকে মন্ত্রীর থাবার মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। এখন উদ্ধার করুন।’
‘আপনার স্ত্রী কেমন আছেন? উনার শরীরের অবস্থা এখন কেমন?’
ওসি সাহেব জবাব দিলেন না। চুপ করে রইলেন।আমি বললাম, ঐদিন যদিও আপনি বলেছেন আপনার স্ত্রী সুস্থ আমার তা মনে হয় না। আমার ধারণা, তিনি বেশ অসুস্থ। আমার ইনট্যুসন পাওয়ার খুব প্রবল। সব সময় তা কাজ করে না। মাঝে মাঝে করে। এখনো করছে। এই যে আপনার সঙ্গে কথা বলছি—এখনো মনে হচ্ছে তিনি খুব অসুস্থ্।
ওসি সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, হ্যাঁ সে অসুস্থ। তাঁর অসুখ সারাবার সাধ্য কারোর নেই। আপনার থাকলেও থাকতে পারে। এটা বড় ব্যাপার না, এই মুহুর্তে বড় ব্যাপার হচ্ছে এখন আপনি আমাকে দয়া করে উদ্ধার করুন। প্রীজ, ঐ বাড়িতে যান।
‘এখন গেলে তো উনাকে পাওয়া যাবে না। মন্ত্রী সাহেব বিকেলে ফিরে ঘণ্টা খানেক ঘুমান, তারপর আবার বের হন। ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা।’
‘উনি না থাকলেও উনার স্ত্রী আছ্নে। উনি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।
ভাই, আপনি কি যাবেন?’
‘যাচ্ছি।’
‘সত্যি যাচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ সত্যি যাচ্ছি।’
‘ভাই অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি না জেনে আপনার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি। দয়া করে ক্ষমা করে দেবেন।’
‘ক্ষমা করে দিলাম। আপনার স্ত্রীর অসুখটা কি?’
‘ওর গলায় ক্যানসার। মাসখানিক আয়ু আছে।’
‘ও আচ্ছা।’
‘আপনি ক্যানসার সারাতে পারেন?’
‘না।’
‘তাও ভাল স্বীকার করলেন। সবাই বলে সারাতে পারে। হোমিওপ্যাথ ডাক্তাররা বলে পারে, কবিরাজ বলে পারে, পীর-ফকির বলে পার।’
‘আপনার স্ত্রীর নাম কি রানু?’
‘তাকে চেনেন?’
‘চিনি না, হঠ্যাৎ মনে হল তাঁর নাম রানু। তাঁর মাথা ভর্তি চুল।’
ওসি সাহেব জবাবে হ্যাঁ-না কিছুই বললেন না।
জহিরদের বাড়িতে তেমন কোন ঝামেলা ছাড়াই ঢুকলাম। জহিরের মা সঙ্গে সঙ্গে দেখা করতে এলেন। ভদ্রমহিলা দেখতে অবিকল তিতলীর মত। যেন মা’র মাথা কেটে তিতলীর ঘাড়ে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। মা-মেয়ের চেহারায় এত মিল সচরাচর চোখে পড়ে না। তবে দু’জনের তাকানোর ভঙ্গি ‍দু’রকম। মা শান্ত চোখে আমাকে দেখছেন। মেয়ের চোখে তীব্র রাগ এবং ঘৃণা। এমণভাবে আমাকে দেখছে যেন মাটির নিচ থেকে অদ্ভুদ জন্তু বের হয়ে এসেছে। মেয়েই প্রথম কথা বলল, আমার ভাই কোথায়?
‘আমি জানি না কোথায়।’
‘দয়া করে মিথ্যা বলবেন না। আপনি যথেষ্ট যন্ত্রনা করেছেন। আমরা আর যন্ত্রনা সহ্য করব না।’
জহিরের মা বললেন, তিতলী তুই চুপ কর তো। চুপ করে বসে থাক। যা বলার আমি বলব। বাবা, তুমি কি সত্যি জান না ও কোথায়?’
‘সত্যি জানি না।’
‘কোথায় থাকতে পারে তা কি জান?’
‘না, তাও জানি না।’
‘কিছু মনে করো না বাবা। আমার কিন্তু মনে হচ্ছে তুমি জান। জেনেও বলছ জানি না।’
‘এ রকম মনে হবার কারণ কি?’
‘ও একটা চিঠি লিখে গেছে। চিঠি থেকে মনে হচ্ছে তুমি জান। তিতলী চিঠিটা এনে একে দেখা।’
‘চিঠি দেখাতে হবে না মা। ব্যক্তিগত চিঠি বাইরের মানুষকে দেখানোর দরকার কি?’
‘ও বাইরের মানুষ না, ও জহিরের বন্ধু। তুই চিঠি নিয়ে আয়।’
তিতলী চিঠি আনতে গেল। ভদ্রমহিলা কপালের ঘাম মুছলেন। তাঁকে খুবেই কাহিল দেখাচ্ছে। চোখ লাল। মনে হয় রাতে ঘুমটুম হচ্ছে না।
‘বাবা, তোমার নামটা যেন কি?’
‘হিমু।’
‘ও হ্যাঁ হিমু। জহির কি তোমার খুব ভাল বন্ধু?’
আমি হাসতে হাসতে বললাম, সেটা জহির বলতে পারবে। আমি তো বলতে পারব না। আমি জহিরকে খুব পছন্দ করি—এইটুকুই বলতে পারি।’
‘কেন পছন্দ কর?’
‘ভাল ছেলে। সরল সাদাসিধা। মনটা গভীর দিঘির জলের মত স্বচ্ছ।’
ভদ্রমহিলা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। মেয়েকে আসতে দেখে চুপ করে গেলেন। তিতলী আমার সামনে চিঠিটা রাখল। তার ফর্সা মুখ এখনো র্ঘনায় কুঁচকে আছে।। তিতলীর মা ক্লান্ত গলায় বললেন,
‘বাবা,চিঠিটা পড়। ‍তুমি কি দুপুরের খাওয়া সেরে এসেছ?’
‘না।’
‘তাহলে এখানেই খাবে। জহিরের বাবা তিনটার দিকে আসবেন, তাঁর সঙ্গে কথা বলে তারপর যাবে।’
‘এখানে তো আমি খেতে পারব না। গোসল না করে আমি কিছু খেতে পারি না। সাতদিন আমি আছি গোসল ছাড়া।’
তিতলী বলল, আপনাকে সেটা বড় গলায় বলতে হবে না। আপনার গা থেকে যে বিকট গন্ধ আসছে তা থেকেই আমরা বুঝতে পারছি।
মা মেয়ের দিকে তাকিয়ে এই প্রথম কঠিন গলায় বললেন, তিতলী, তুই ভেতরে যা। এই ছেলে এখানে খাবে। ও গোসলের ব্যবস্থা করতে বল। বাথরুমে তোয়ালে সাবান দাও।
তিতলী উঠে গেল। তিনি আমার দিকে বললেন—বাবা, ‍তুমি আমার ছেলে প্রসঙ্গে যে কথাগুলি বলেছ সেগুলি আমার এই মেয়ে প্রসঙ্গেও সত্য। আমার এই মেয়ের মনটাও গভীর দিঘির জলের মত স্বচ্ছ। ও তোমার উপর রেগে আছে বলে এরকম করছে। ওর ধারণা….
ভদ্রমহিলা কথা শেষ করলেন না। সম্ভবত মেয়ের ধারণার কথা তিনি আমাকে বলতে চান না। আমি জহিরের চিঠি পড়তে শুরু করলাম। চিঠিতে কোন সম্বোধন নেই। তবে বোনকে লেখা, তা বোঝা যাচ্ছে।
আমার এই চিঠি পড়ে খুব রাগ করবি। একবার ভেবেছিলাম চিঠি লিখব না। তাতে সবাই দুঃশ্চিন্তা বেশি করবে। তাই এই চিঠি। তোদের সঙ্গে আমি থাকতে পারছি না। মানুষ হিসেবে বাবা অত্যন্ত নিম্নমানের। তিনি অনর্গল মিথ্যা বলেন। একের পর এক আজে বাজে কাজ করে যান। কিছু কিছু কাজ এমন যে শয়তানের পক্ষেও করা সহজসাধ্য না। উদাহরণ দেই—আমাদের গ্রামের বাড়ির বুলু মাস্টার। ভদ্রলোক নিতান্তই ভাল মানুষ। তাঁর অপরাধের মধ্যে অপরাধ হচ্ছে, ইলেকসনের সময় বাবার বিরুদ্ধে নানান কথা বলেছে যেন লোকজন বাবাবে ভোট না দেয়। সে যে সমস্ত কথা বলেছে তার প্রতিটি বাক্য সত্য। যাই হোক। বাবা তাঁকে খুনের মামলায় এমন ফাঁসানো ফাসিয়েছেন যে এক থাক্কায় যাবজ্জীবন হয়ে গেল। এই জাতীয় মানুষের সঙ্গে কি বাস করা যায়? তুই-ই বল। মা’ও যে বাবার চেয়ে আলাদা, তা না। বাবার প্রতিটি অন্যায় মা সমর্থন করে যাচ্ছেন। আদর্শ স্বামীর আদর্শ স্ত্রী। বাবাকে একবার তিন লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে গেল। টাকাটা দিয়ে গেল মা’র হাতে। মা শান্ত ভঙ্গিতে সেই টাকা আয়রণ সেফে তুলে রাখলেন। তাঁর মধ্যে কোন বিকার নেই। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। কোথায় যাব জানি না। গর্ত খুঁড়ে মাটিতে ঢুকতে ইচ্ছা করছে। ভাল কথা, ঐ রাতে হিমুর সঙ্গে গর্ত খুঁড়ে বসেছিলাম—দারুন লাগছিল। দু’জনেই থানায় গেলাম, বাবা আমাকে ছাড়িয়ে আনলেন, হিমুকে আনলেন না। বেচারা একা বসে রইল। পুলিশ নিশ্চয়ই তাকে মারধোরও করেছে। বাবা সেরকম ইঙ্গিত দিয়ে এসেছেন। অবশ্য এতে হিমুর কিছুই যাবে আসবে না। পুলিশের পক্ষে ওকে হজম করা মুশকিল। ও কঠিন চিজ।
তুই ভাল থাকিস। প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাক যাতে তুইও বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পারিস। বাঁচার পথ একটাই। তোর ড্রয়ার থেকে কিছু টাকা নিয়ে গেলাম। একবারে খালি হাতে বে হতে সাহস পাচ্ছি না।
‘বাবা চিঠি পড়লে?’
‘জ্বি পড়লাম।’
‘কিছু বলবে?’
‘ও কত টাকা নিয়েছে?’
‘সাতশ তেত্রিশ টাকা।’
‘চিন্তার কোন কারণ দেখি না। টাকা শেষ হলেই ফিরে আসবে। আগেও তো অনেকবার পালিয়েছে। নতুন কিছু তো না।’
জহিরের বাবাও তাই বলেছেন। কিন্তু আমি ভরসা পাচ্ছি না। রোজ রাতে দুঃস্বপ্ন দেখি। ঐ দিন দেখলাম…
তিতলী বলল, গোসলের পানি দেয়া হয়েছে, আপনি আসুন। মেয়েটা এখনো চোখে-মুখে ঘৃণা ধরে আছে। ভালবাসা অনেকক্ষণ ধরে রাখা যায়, ঘৃণা না। মেয়েটা কি করে ধরে রেখেছে সে-ই জানে।
‘কি হল, বস আছেন কেন? আসুন।’
আমি সঙ্গে সঙ্গে উঠে এলাম এবং বাথরুমে ঢোকার আগে থমকে দাঁড়িয়ে বললাম, আপনাদের বাথরুমে কি বাথটাব আছে?
‘হ্যাঁ আছে।’
‘তাহলে দয়া করে দু’কেজি বরফের ব্যবস্থা করুন। বাথটাবে পানি দিয়ে আমি তার মধ্যে দু’কেজি বরফ ছেড়ে দেব। তারপর নাক ভাসিয়ে শুয়ে থাকব।’
‘পাগলামী কথাবার্তা আমার সঙ্গে বলবেন না। পাগলামী কথা শুনে আমি মুগ্ধ হই না। আমি জহির না।’
‘আপনাদের ডীপ ফ্রীজে বরফ নেই?’
তিতলী জবাব দিল না। আমি আশাও করিনি।
মন্ত্রীর বাড়িতে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন প্রচুর থাকবে এটা ভাবাই স্বাভাবিক। বিশাল ডাইনিং টেবিল থাকবে।চায়নীজ রেস্টুরেন্টের মত উর্দিপরা বয় থাকবে। ন্যাপকিন-কাটাচামচ থাকবে। সে রকম কিছু না। খেতে এসে দেখি খুবই এলেবেলে ব্যবস্থা। খাবার টেবিলটা ছোট। টেবিল ক্লথে তরকারির দাগ লেগে আছে। উর্দিপরা বয় বাবুর্চি দেখলাম না—বৃদ্ধা এক কাজের মেয়েকে দেখলাম তিতলী যাকে বড় বুবু করে ডাকছে। আয়োজনের সামান্য—রুগ্ন ধরনের কই মাছ, মুরগীর মাংস, ডাল এবং কালচে ধরনের পেপেভাজি।
তিতলী কঠিন ভঙ্গিতে বলল, খেতে বসুন।
‘আপনাদের খাওয়া হয়ে গেছে?’
‘খাওয়া না হলেও আপনার সঙ্গে বসে খাব এরকম ভাবছেন কেন?’
‘ভাবছি না।’
‘না ভাবলেই ভাল, বড়বুবু আছেন কিছু লাগলে উনাকে বলবেন, উনি দেবেন। আমি এসেছি শুধু আপনাকে একটা খবর দেবার জন্যে।
‘কি খবর?’
‘আপনি যে এসেছেন বাবাকে বলা হয়েছে। বাবা একটা কেবিনেট মিটিংএ আটকা পড়েছেন।আসতে রাত হবে। বাবার সঙ্গে দেখা না করে আপনি যাবেন না। খাওয়া শেষ হলে বড় বুবু আপনাকে ভাইয়ার ঘরে নিয়ে যাবে। আপনি ঐ ঘরে বিশ্রাম করবেন।’
‘হাউস এ্যারেস্ট?’
‘ভাইয়া চিঠিতে লিখেছে কেউ আপনাকে হজম করতে পারে না। আমরা পারব কেন? আপনাকে থাকতে বলা হয়েছে, আপনি থাকবেন।’
ঠিক আছে থাকব। তুমি বস, খেতে খেতে গল্প করি। আমার সঙ্গে গল্প করবে? আমি অনেক হাসির গল্প জানি।’
‘আপনার সঙ্গে গল্প করব মানে? হু আর ইউ? তাছাড়া তুমি করে বলছেন কেন? বাংলা সিনেমা পেয়েছেন? সব জায়গায় ভড়ং চলে না। মনে রাখবেন।’
‘আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, তিতলী তুমি গল্প করতে না চাও করবে না। চেঁচামেচি করছ কেন? কেউ খাওয়ার সময় চেঁচামেচি করলে আমি খেতে পারি না। হাজার হলেও তোমাদের অতিথি। তাছাড়া খাবার আয়োজনও ভাল না। গল্পগুজব না করলে এইসব খাবার আরো বিস্বাদ লাগে।
‘তুমি তুমি করে কেন আপনি আমার সঙ্গে কথা বলছেন? এই অধিকার আপনাকে কে দিল? এত সাহস আপনি কোথেকে পাচ্ছেন? আমি আপনাকে একটা শিক্ষা দেব। এমন শিক্ষা দেব যে আপনি কোনদিন ভুলবেন না।’
জহিরের মা এই পর্যায়ে খাবার ঘরে ঢুকে বললেন, কি হয়েছে?
তিতলী বলল, কিছু না।
জহিরের মা বললেন, বাবা তোমাকে রাত এগারোটা পর্যন্ত থাকতে হবে। তোমাকে কি তিতলী এই কথা বলেছে?
‘বলেছে। আমার কোন অসুবিধা নেই।’
‘খেতে পারছ বাবা?’
‘আমাকে এত ঘন ঘন বাবা বলবেন না। আমার খুব অস্বস্থি লাগে।’
‘তোমার মা যখন বলেন তখনো কি অস্বস্থি লাগে?’
‘মা বলার সুযোগ পান নি। মা বললেও লাগতো বলেই আমার ধারণা’
রাত এগারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হল না। মোবারক হোসেন সাহেব ন’টার দিকে বাসায় ফিরলেন। আমার ডাক পড়ল দশটায়। দোতলা পেছনের দিকের বারান্দায় তিনি বসে আছেন। বসে না, ইজিচেয়ারে আধাশোয়া অবস্থায় আছেন। পা দু’টা মোড়ার উপর। খালি গা, হাঁটু পর্যন্ত তোলা এক লুঙ্গি কোন রকমে কোমরে জড়ানো। তিতলী আমাকে নিয়ে গেল। তিনি হাই তুলতে তুলতে বললেন, বোস।
হাতলবিহীন একটা চেয়ার রাখা হয়েছে আমার জন্যে। আমি বসলাম। তিনি আবারো হাই তুলতে তুলতে তিতলীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ঘরে টক দৈ আছে কি-না দেখতো মা। থাকলে আমাকে এক বাটি দিয়ে যাও।
তিতলী চলে গেল। তিনি চোখ বন্ধ করে ফেললেন। আমার সঙ্গে কথা বলার কোন রকম আগ্রহ দেখলাম না। তাঁর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তিনি ঘুমিয়ে পড়ছেন। তবে মোড়ায় রাখা পা নড়ছে। তা থেকে ধারণা করা যেতে পারে ভদ্রলোক জেগেই আছেন।
‘হিমু।’
‘জ্বি স্যার।’
‘প্রথমেই তোমার একটা ভুল ধারণা ভাঙ্গানো দরকার। আমার স্ত্রী এবং কন্যার আচার আচরণে তোমারা হয়ত ধারণা হয়েছে জহিরের পালিয়ে যাবার ব্যাপারটায় আমি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন, দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত। ব্যাপারটা মোটেই তা না। এটা নতুন কোন ঘটনা না। এ জাতীয় ঘটনা আগেও ঘটেছে। আমি বরং খুশি যে সে বাড়ি থেকে বিদেয় হয়েছে। তোমাদের বাংলায় একটা প্রবচন আছে না—দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভাল?’
‘উল্টা প্রবচনও আছে স্যার, ‘নাই গরুর চেয়ে কানা গরু ভাল।’ অবশ্যি প্রবচন একটু অন্যভাবে আছে—নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল। মুল ভাব কিন্তু এক।’
‘হিমু।’
‘জ্বি স্যার।’
‘আমার চেহারায় কোথায় যেন একটু বোকা ভাব আছে। যার সঙ্গেই কথা বলি সেই আমাকে জ্ঞান দিতে চেষ্টা করে। যদিও আমি মানুষটা বোকা না। একটা বোকা লোক সব সরকারের আমলে মন্ত্রী হয় না। এক সরকারের আমলে হয় অন্য সরকারের আমলে জেলে চলে যায়। আমি এখনও জেলে যাইনি।
‘আপনি বুদ্ধিমান এই নিয়ে আমার মনে কোন সন্দেহ নেই।’
‘বুদ্ধিমান মানুষ আবার নানা ধরনের আছে। কিছু মানুষ আছে যারা বড় সমস্যা। সমাধানে বুদ্ধিমান, আবার ক্ষুদ্র সমস্যার ব্যাপারে না। আমি ছোট এবং আপাতত তুচ্ছ বিষয়েও বুদ্ধিমান। প্রমাণ চাও?’
‘আমি চাচ্ছি না। আপনি দিতে চাইলে দিতে পারেন।’
‘বেশ প্রমাণ দিচ্ছি। তোমাকে নিয়ে আমার মেয়ে উপস্থিত হল। আমি চাচ্ছিলাম না আমাদের কথাবার্তায় সে থাকুক। তাকে চলে যেতে ও বলতে চাইলাম না, কারণ তাতে তার ধারণা হতে পারে আমি তোমার সঙ্গে জরুরী কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলছি। কাজেই তাকে টক দৈ আনতে বললাম। আমি জানি ঘরে টক দৈ নেই। দোকান থেকে আনতে হবে। এতে খুব কম করে ও হলে আধ ঘণ্টা সময় লাগবে। তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্যে আধ ঘণ্টা যথেষ্ট। আশা করি প্রমাণ পেয়েছে যে আমি বুদ্ধিমান।’
‘জ্বি পেয়েছি। বলুন কি বলবেন।’
‘আমার স্ত্রীর কাছ থেকে শুনলাম জহিরের চিঠি তুমি পড়েছ। যে ছেলে নিজের বাবা-মা সম্পর্কে এত কুৎসিত কথা লিখতে পারে তার বাড়িতে থাকার এমনিতেই কোন অধিকার নেই। সে চলে গেছে ভাল করেছে। গুড ফর হিম। আমার সম্পর্কে
যে সব অভিযোগ এনেছে তার প্রত্যেকটার জবাব দেয়া যায়। কী জবাব দেব তুমি কি শুনতে চাও?’
‘না।’
‘শুধু একটার জবাব দিচ্ছি—বুলু মাষ্টারের ব্যাপারটা। লোকটা হাড়ে হাড়ে বজ্জাত। স্কুল টিচার, তার কাজ হচ্ছে ছাত্র পড়ানো। করে পলিটিক্স। সারাক্ষণ আমার বিরুদ্ধে লেগে ছিল। ইচ্ছা করলেই হারামজাদাকে আমি দশ হাত পানির নিচে পুঁতে ফেলতে পারতাম। তা করিনি। আমি মন্ত্রী হয়ে যাবার পর স্থানীয় লোকজন আমাকে খুশি করবার জন্যে তাকে খুনের মামলায় জড়িয়ে ফেলল।
খেয়াল রাখবে আমি কাউকে কিছু করতে বলিনি। ওসি আমাকে খুশি করতে চাইল, স্থানীয় মেম্বার-চেয়ারম্যান খুশি করতে চাইল, একদল মিথ্যা সাক্ষী জুটে গেল। একদল অসৎ লোক মিলে কাণ্ডটা করল।’
‘আপনি কি খুশি হলেন?’
‘আমি সহজে খুশি হই না, সহজে ব্যাজারও হই না। আমার পুত্র এইসব ব্যাপার জানে না। সে জানে আমি শয়তান ধরণের মানুষ। ভাল কথা। ছেলে উপযুক্ত হয়েছে সে তার নিজস্ব ধারণা করতেই পারে—ছেলের ব্যাপারে আমার মোটেই মাথা ব্যথা নেই। আমি তোমার ব্যাপারটা জানতে চাচ্ছি।’
মোবারক হোসেন সাহেব এই প্রথম চোখ মেললেন। আধশোয়া অবস্থা থেকে উঠে বসলেন। আমি খানিকটা হকচকিয়ে গিয়ে বললাম, আমার কি ব্যাপার জানতে চান?’
‘সব কিছুই জানতে চাই। আমি কিছু খোঁজ-খবর করিয়েছি। এখনো করছি। তোমার উদ্দেশ্যটা কি? জহিরকে গর্ত খুঁড়ে বসিয়ে রাখার কাজটা যে ‍তুমি করেছ, আমার ধারণা তা খুব ভেবে চিন্তে করেছ। এর পেছনে তোমার পরিকল্পনা আছে। পরিকল্পনাটা কি ? চট করে জবাব দিতে হবে না। ভাব। ভেবে ভেবে জবাব দাও।’
আমি চুপ করে রইলাম। মোবারক সাহেব চাপা গলায় বললেন, তুমি কি নিজেকে মহাপুরুষ মনে কর?
‘না।’
‘অনেকেই মনে করে।’
‘কেউ কেউ করে।’
‘অনেকের ধারণা তোমার সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার আছে। যে ওসি তোমাদের ধরে থানায় নিয়ে গিয়েছিল তাঁরও ধারণা সে রকম। তোমার কি আছে কোন সুপারন্যাচারাল ক্ষমতা?’
‘না। তবে আমার ইনট্যুশন ক্ষমতা প্রবল। মাঝে মাঝে দু’একটা কথা বলে ফেলতে পারি।’
‘সে তো সবাই পারে। তোমার ইনট্যুশন এই মুহূর্তে কি বলছে?’
‘এই মুহূর্তে আমার ইনট্যুশন বলছে আপনি বড় রকমের ঝামেলায় পড়েছেন। এখন আর তেল এবং জ্বালানি মন্ত্রী না।’
মোবারক হোসেন শীতল গলায় বললেন, তোমার ইনট্যুশন ক্ষমতা কিছুটা হয়ত আছে, কিন্তু বলা যায় অনুমান শক্তি প্রবল। ব্যাপারটা ঘটেছে আজ রাত আটটায়, তোমার জানার কথা না। প্রেসিডেণ্টের গুডবুক থেকে নাম কাটা গেছে, গুড বুক থেকে নাম কাটা গেলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যাড বুকে নাম উঠে যায়। সেখানে নাম উঠে গেছে। আমাকে জেলে যেতে হতে পারে। তোমার ইনট্যুশন কি বলে?
‘আমার ইনট্যুশন কিছু বলছে না।’
মোবারক হোসেন আবার ইজিচেয়ারে শুয়ে পড়লেন। চোখ বন্ধ হয়ে গেল। মোড়ায় রাখা তাঁর পায়ের বুড়ো আঙুল কাঁপতে লাগল। মনে হয় এই হল তাঁর চিন্তার পদ্ধতি।
‘হিমু।’
‘জ্বি স্যার।’
‘আমাকে জেলে ঢুকানো সহজ না। এতে থলের বিড়াল বের হয়ে যাবে। আমাকে অখুশি করাও বর্তমানে সরকারের পক্ষে খুব রিস্কি।’ মেরে ফেললে ভিন্ন কথা। তোমার ইনট্যুশন কি বলে?’
‘কিছু বলছে না।’
‘তোমাকে ডেকে আনার কারণ এখন বলি, ভাল কথা, তুমি নিজে কি কিছু আন্দাজ করতে পারছ?’
‘না।’
‘কথা বলার জন্য ডাকলাম আর কিছু না। একটা পর্যায় আছে যখন কথা বলার কেউ আশেপাশে থাকে না। আমার অনেক কথা আছে। বলার মানুষ নেই। জহিরের বিষয় নিয়ে মাথাব্যাথা নেই। লেট হিম গো টু হেল। অবশ্য গেছেও তাই। কোথায় আছে সেই খোঁজ বের করা আমার পক্ষে কঠিন না। বের করতে চাচ্ছি না। আমার মনে ক্ষীণ সন্দেহ, তুমি আমার সঙ্গে একধরনের খেলা খেলার চেষ্টা করছ। ভাল কথা, খেল। শুধু জানিয়ে রাখলাম—যে খেলাটা তুমি গোপনে খেলতে পারছ না। আমি জানি।’
তিতলী টক দৈয়ের বাটি নিয়ে ঢুকল। আমি বললাম, চাচা আমি কি এখন যেতে পারি?
‘অবশ্যই যেতে পার। তোমাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়নি। গুড নাইট।’
Print Friendly, PDF & Email

0 Response to " "

Post a Comment

প্রতি ক্লিকে ইনকাম