প্রতি বছর শীতের ছুটির সময় ভাবি কিছুদিন গ্রামে কাটিয়ে আসব। দলবল নিয়ে যাব- হৈচৈ করা যাবে। আমার বাচ্চারা কখনও গ্রাম দেখেনি- তারা খুশি হবে। পুকুরে ঝাঁপাঝাঁপি করতে পারবে। শাপলা ফুল শুধু যে মতিঝিলের সামনেই ফোটে না, অন্যান্য জায়গাতেও ফোটে তাও স্বচক্ষে দেখবে।
আমার বেশির ভাগ পরিকল্পনাই শেষ পর্যন্ত কাজে লাগাতে পারি না। এটা কেমন করে জানি লেগে গেল।
একদিন সত্যি সত্যি রওনা হলাম।
আমাদের গ্রামটাকে অজ পাড়াগাঁ বললেও সম্মান দেখানো হয়। যোগাযোগ-ব্যবস্থার এমন সুন্দর সময়েও সেখানে পৌঁছাতে হয় গরুর গাড়িতে। বর্ষার সময় নৌকা, তবে মাঝখানে একটা হাওর পড়ে বলে সেই যাত্রা অগস্ত্যযাত্রার মতো।
অনেকদিন পর গ্রামে গিয়ে ভালো লাগল। দেখলাম আমার বাচ্চাদের আনন্দবর্ধনের সব ব্যবস্থাই নেওয়া হয়েছে। কোত্থেকে যেন একটা হাড়জিরজিরে বেতো ঘোড়া জোগাড় করা হয়েছে। এই ঘোড়া নড়াচড়া করে না, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। খুব বেশি বিরক্ত হলে দীর্ঘনিশ্বাসের মতো একটা শব্দ করে এবং লেজটা নাড়ে। বাচ্চারা এতবড় একটা জীবন্ত খেলনা পেয়ে মহাখুশি। দু-তিনজন একসঙ্গে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসে থাকে।
তাদের অসংখ্য বন্ধু-বান্ধবও জুটে গেল। যেখানেই যায় তাদের সঙ্গে গোটা পঞ্চাশেক ছেলেপুলে থাকে। আমার বাচ্চারা যা করে তাতেই তারা চমৎকৃত হয়। আমার বাচ্চারা তাদের বিপুল জনপ্রিয়তায় অভিভূত। তারা তাদের যাবতীয় প্রতিভা দেখাতে শুরু করল-কেউ কবিতা বলছে, কেউ গান, কেউ ছড়া।
আমি একগাদা বই সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার পরিকল্পনা- পুরোপুরি বিশ্রাম নেওয়া। শুয়ে বসে বই পড়া, খুব বেশি ইচ্ছা করলে খাতা-কলম নিয়ে বসা। একটা উপন্যাস অর্ধেকের মতো লিখেছিলাম, বাকিটা কিছুতেই লিখতে ইচ্ছা করছিল না। পান্ডুলিপি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। নতুন পরিবেশে যদি লিখতে ইচ্ছা করে।
প্রথম কিছুদিন বই বা লেখা কোনোটাই নিয়ে বসা গেল না। সারাক্ষণই লোকজন আসছে। তারা অত্যন্ত গম্ভীর গলায় নানান জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনায় উৎসাহী। এসেই বলবে- ‘দেশের অবস্থাডা কী কন দেহি ছোডমিয়া। বড়ই চিন্তাযুক্ত আছি। দেশের হইলডা কী? কী দেশ ছিল আর কী হইল?’
দিন চার-পাঁচেকের পর সবাই বুঝে গেল দেশ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। গল্পগুজবও তেমন করতে পারি না। তারা আমাকে রেহাই দিল। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। গ্রামের নতুন পরিবেশের কারণেই হোক বা অন্য কোনও কারণেই হোক আমি লেখালেখির প্রবল আগ্রহ বোধ করলাম। অসমাপ্ত পান্ডুলিপি নিয়ে বসলাম। সারাদিন লেখালেখি কাটাকুটি করি, সন্ধ্যায় স্ত্রীকে সঙ্গে করে বেড়াতে বের হই। চমৎকার লাগে। প্রায় রাতেই একজন দুজন করে ‘গাতক’ আসে। এরা জ্যোৎস্নাভেজা উঠোনে বসে চমৎকার গান ধরে-
“ও মনা
এই কথাটা না জানলে প্রাণে বাঁচতাম না।
না না না-আমি প্রাণে বাঁচতাম না।”
সময়টা বড় চমৎকার কাটতে লাগল। লেখার ব্যাপারে আগ্রহ বাড়তেই লাগল। সারাদিনই লিখি।
এক দুপুরের কথা- একমনে লিখছি। জানালার ওপাশে খুট করে শব্দ হলো। তাকিয়ে দেখি খালিগায়ে রোগামতো দশ-এগারো বছরের একটা ছেলে গভীর আগ্রহে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে আগেও দেখেছি। জানালার ওপাশ থেকে গভীর কৌতূহলে সে আমাকে দেখে। চোখে চোখ পড়লেই পালিয়ে যায়। আজ পালাল না।
আমি বললাম- কী রে?
সে মাথাটা চট করে নামিয়ে ফেলল।
আমি বললাম- চলে গেলি নাকি?
ও আড়াল থেকে বলল- না।
‘নাম কী রে তোর?’
‘মন্তাজ মিয়া।’
‘আয় ভেতরে আয়।’
‘না।’
আর কোনও কথাবার্তা হল না। আমি লেখায় ডুবে গেলাম। ঘুঘুডাকা শ্রান্ত দুপুরে লেখালেখির আনন্দই অন্যরকম। মন্তাজ মিয়ার কথা ভুলে গেলাম।
পরদিন আবার এই ব্যাপার। জানালার ওপাশে মন্তাজ মিয়া। বড় বড় কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম- কী ব্যাপার মন্তাজ মিয়া? আয় ভেতরে।
সে ভেতরে ঢুকল।
আমি বললাম, থাকিস কোথায়?
উত্তরে পোকা-খাওয়া দাঁত বের করে হাসল।
‘স্কুলে যাস না?’
আবার হাসি। আমি খাতা থেকে একটা সাদা কাগজ ছিঁড়ে তার হাতে দিলাম। সে তার এই বিরল সৌভাগ্যে অভিভূত হয়ে গেল। কী করবে বুঝতে পারছে না। কাগজটার গন্ধ শুঁকল। গালের উপর খানিকক্ষণ চেপে রেখে উল্কার বেগে বেরিয়ে গেল।
রাতে খেতে খেতে আমার ছোট চাচা বললেন- মন্তাজ হারামজাদা তোমার কাছে নাকি আসে? আসলে একটা চড় দিয়ে বিদায় করবে।
‘কেন?’
‘বিরাট চোর। যা-ই দেখে তুলে নিয়ে যায়। ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দিবে না। দুই দিন পরপর মার খায় তাতেও হুঁশ হয় না। তোমার এখানে এসে করে কী?’
‘কিছু করে না।’
‘চুরির সন্ধানে আছে। কে জানে এর মধ্যে হয়তো তোমার কলম-টলম নিয়ে নিয়েছে।’
‘না, কিছু নেয়নি।’
‘ভালো করে খুঁজে-টুজে দ্যাখো। কিছুই বলা যায় না। ঐ ছেলের ঘটনা আছে।’
‘কী ঘটনা?’
‘আছে অনেক ঘটনা। বলব একসময়।
পরদিন সকালে যথারীতি লেখালিখি শুরু করেছি। হৈচৈ শুনে বের হয়ে এলাম। অবাক হয়ে দেখি মন্তাজ মিয়াকে তিন-চারজন চ্যাংদোলা করে নিয়ে এসেছে। ছেলেটা ফোঁপাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে প্রচন্ড মার খেয়েছে। ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়ছে। একদিকের গাল ফুলে আছে।
আমি বললাম, কী ব্যাপার?
শাস্তিদাতাদের একজন বলল, দেখেন তো এই কলমটা আপনের কি না। মন্তাজ হারামজাদার হাতে ছিল।
দেখলাম কলমটা আমারই, চার-পাঁচ টাকা দামের বলপয়েন্ট। এমন কোনও মহার্ঘ বস্তু নয়। আমার কাছে চাইলেই দিয়ে দিতাম। চুরি করার প্রয়োজন ছিল না। মনটা একটু খারাপই হল। বাচ্চা বয়সে ছেলেটা এমন চুরি শিখল কেন? বড় হয়ে এ করবে কী?
‘ভাইসাব, কলমটা আপনার?’
‘হ্যাঁ। তবে আমি এটা ওকে দিয়ে দিয়েছি। ছেড়ে দিন। বাচ্চা ছেলে এত মারধর করেছেন কেন? মারধর করার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করে নেবেন না?’
শাস্তিদাতা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, এই মাইরে ওর কিছু হয় না। এইডা এর কাছে পানিভাত। মাইর না খাইলে এর ভাত হজম হয় না।
মন্তাজ মিয়া বিস্মিত চোখে আমাকে দেখছে। তাকে দেখেই মনে হল সে তার ক্ষুদ্র জীবনে এই প্রথম একজনকে দেখছে যে চুরি করার পরও তাকে চোর বলেনি। মন্তাজ মিয়া নিঃশব্দে বাকি দিনটা জানালার ওপাশে বসে রইল। অন্যদিন তার সঙ্গে দুএকটা কথাবার্তা বলি, আজ একটা কথাও বলা হল না। মেজাজ খারাপ হয়েছিল। এই বয়সে একটা ছেলে চুরি শিখবে কেন?
মন্তাজ মিয়ার যে একটা বিশেষ ঘটনা আছে তা জানলাম আমার ছোট চাচির কাছে। চুরির ঘটনারও দুদিন পর। গ্রামের মানুষদের এই একটা অদ্ভুত ব্যাপার। কোন ঘটনা যে গুরুত্বপূর্ণ, কোনটা তুচ্ছ তা এরা বুঝতে পারে না। মন্তাজ মিয়ার জীবনের এত বড় একটা ব্যাপার কেউ আমাকে এতদিন বলেনি, অথচ তুচ্ছ সব বিষয় অনেকবার করে শোনা হয়ে গেছে। মন্তাজ মিয়ার ঘটনাটা এই-
তিন বছর আগে কার্তিক মাসের মাঝামাঝি মন্তাজ মিয়া দুপুরে প্রবল জ্বর নিয়ে বাড়ি ফেরে। সেই জ্বরের প্রকোপ এতই বেশি যে শেষ পর্যন্ত মন্তাজ মিয়ার হতদরিদ্র বাবা একজন ডাক্তারও নিয়ে এলেন। ডাক্তার আনার কিছুক্ষণের মধ্যেই মন্তাজ মিয়া মারা গেল। গ্রামে জন্ম এবং মৃত্যু দুটোই বেশ স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা হয়। মন্তাজ মিয়ার মা কিছুক্ষণ চিৎকার করে কাঁদল। তার বাবাও খানিকক্ষণ ‘আমার পুত কই গেলরে’ বলে চেঁচিয়ে স্বাভাবিক হয়ে গেল। বেঁচে থাকার প্রবল সংগ্রামে তাদের লেগে থাকতে হয়। পুত্রশোকে কাতর হলে চলে না। মরা মানুষ যত তাড়াতাড়ি কবর দিয়ে দেওয়া হয় ততই নাকি সোয়াব এবং কবর দিতে হয় দিনের আলো থাকতে থাকতে। কাজেই জুম্মাঘরের পাশে বাদ আছর মন্তাজ মিয়ার কবর হয়ে গেল। সবকিছুই খুব কটা সুযোগ। এই সুযোগ তারা নষ্ট করবে না। আমি আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেউ কি এসেছে? ‘আসব না মানে? গেরামের একটা নিয়ম-শৃঙ্খলা আছে না?’ আমি ছোট চাচাকে বললাম, আমাদের উপলক্ষে যেসব মেয়ে নাইওর আসবে তাদের প্রত্যেককে যেন একটা করে দামি শাড়ি উপহার হিসেবে দেওয়া হয়, একদিন খুব যত্ন স্বাভাবিকভাবে। অস্বাভাবিক ব্যাপারটা শুরু হল দুপুর রাতের পর, যখন মন্তাজ মিয়ার বড় বোন রহিমা কলমাকান্দা থেকে উপস্থিত হল। কলমাকান্দা এখান থেকে একুশ মাইল। এই দীর্ঘ পথ একটি গর্ভবতী মহিলা পায়ে হেঁটে চলে এল এবং বাড়িতে পা দিয়েই চেঁচিয়ে বলল, তোমরা করছ কী? মন্তাজ বাঁইচ্যা আছে। কবর খুঁইড়া তারে বাইর কর। দিরং কবরা না। বলাই বাহুল্য, কেউ তাকে পাত্তা দিল না। শোকে-দুঃখে মানুষের মাথা খারাপ হয়ে যায়। কবর দিয়ে দেওয়ার পর নিকট আত্মীয়-স্বজনরা সবসময় বলে-“ও মরে নাই।” কিন্তু মন্তাজ মিয়ার বোন রহিমা এই ব্যাপারটা নিয়ে এতই হৈচৈ শুরু করল যে সবাই বাধ্য হল মৌলানা সাহেবকেডেকে আনতে। রহিমা মৌলানা সাহেবের পায়ে গিয়ে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, মন্তাজ বাঁইচ্যা আছে- আপনে এরে বাঁচান। আপনে না বললে কবর খুঁড়ত না। আপনে রাজি না হওয়া পর্যন্ত আমি পাও ছাড়তাম না। মৌলানা সাহেব অনেক চেষ্টা করেও রহিমাকে ঝেড়ে ফেলতে পারলেন না। রহিমা বজ্রআঁটুনিতে পা ধরে বসে রইল। মৌলানা সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন- বাঁইচা আছে বুঝলা ক্যামনে? রহিমা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, আমি জানি। গ্রামের মৌলানারা অতি কঠিনহৃদয়ের হয় বলে আমাদের একটা ধারণা আছে। এই ধারণা সত্যি নয়। মৌলানা সাহেব বললেন- প্রয়োজনে কবর দ্বিতীয়বার খোঁড়া জায়েজ আছে। এই মেয়ের মনের শান্তির জন্যে এটা করা যায়। হাদিস শরীফে আছে… কবর খোঁড়া হল। ভয়াবহ দৃশ্য! মন্তাজ মিয়া কবরের গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে। পিটপিট করে তাকাচ্ছে। হঠাৎ চোখে প্রবল আলো পড়ায় চোখ মেলতে পারছে না। কাফনের কাপড়ের একখ- লুঙ্গির মতো পেঁচিয়ে পরা। অন্য দুটি খন্ড সুন্দর করে ভাঁজ করা। অসংখ্য মানুষ জমা হয়ে আছে। এই অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখে কারো মুখে কোনও কথা সরল না। মৌলানা সাহেব বললেন- কীরে মন্তাজ? মন্তাজ মৃদুস্বরে বলল, পানির পিয়াস লাগছে। মৌলানা সাহেব হাত বাড়িয়ে তাকে কবর থেকে তুললেন। এই হচ্ছে মন্তাজ মিয়ার গল্প। আমি আমার এই জীবনে অদ্ভুত গল্প অনেক শুনেছি, এ রকম কখনো শুনিনি। ছোট চাচাকে বললাম, মন্তাজ তারপর কিছু বলেনি? অন্ধকার কবরে জ্ঞান ফিরবার পর কী দেখল না-দেখল এইসব? ছোট চাচা বললেন- না। কিচ্ছু কয় না। হারামজাদা বিরাট বজ্জাত। ‘জিজ্ঞেস করেননি কিছু?’ ‘কত জনে কত জিজ্ঞেস করছে। এক সাংবাদিকও আসছিল। ছবি তুলল। কত কথা জিজ্ঞেস করল-একটা শব্দ করে না। হারামজাদা বদের হাড্ডি।’ আমি বললাম, কবর থেকে ফিরে এসেছে-লোকজন তাকে ভয়-টয় পেত না? ‘প্রথম প্রথম পাইত। তারপর আর না। আল্লাহ্তায়ালার কুদরত। আল্লাহ্তায়ালার কেরামতি আমরা সামান্য মানুষ কী বুঝব কও?’ ‘তা তো বটেই। আপনারা তার বোন রহিমাকে জিজ্ঞেস করেননি সে কী করে বুঝতে পারল মনত্মাজ বেঁচে আছে?’ ‘জিজ্ঞেস করার কিছু নাই। এইটাও তোমার আল্লাহ্র কুদরত। উনার কেরামতি।’ ধর্মকর্ম করুক বা না-করুক গ্রামের মানুষদের আল্লাতায়ালার ‘কুদরত’ এবং কেরামতির’ উপর অসীম ভক্তি। গ্রামের মানুষদের চরিত্রে চমৎকার সব দিক আছে। অতি তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে এরা প্রচুর মাতামাতি করে, আবার অনেক বড় বড় ঘটনা হজম করে। দার্শনিকের মতো গলায় বলে ‘আল্লাহ্র কুদরত’। আমি ছোট চাচাকে বললাম, রহিমাকে একটু খবর দিয়ে আনানো যায় না? ছোট চাচা বিস্মিত হয়ে বললেন, কেন? ‘কথা বলতাম।’ ‘খবর দেওয়ার দরকার নাই। এম্নেই আসব।’ ‘এম্নিতেই আসবে কেন?’ ছোট চাচা বললেন- তুমি পুলাপান নিয়া আসছ। চাইরদিকে খবর গেছে। এই গেরামের যত মেয়ের বিয়া হইছে সব অখন নাইওর আসব। এইটাই নিয়ম। আমি অবাকই হলাম। সত্যি সত্যি এটাই নাকি নিয়ম। গ্রামের কোনো বিশিষ্ট মানুষ আসা উপলক্ষে গ্রামের সব মেয়েনাইওর আসবে। বাপের দেশের আসার এটা তাদের একরে দাওয়াত খাওয়ানো হয়। ছোট চাচা এটা পছন্দ করলেন না। তবে তাঁর রাজি না হয়েও কোনও উপায় ছিল না। আমাদের জমিজমা তিনি দীর্ঘদিন ধরে ভোগদখল করছেন। গ্রামের নিয়মমতো একসময় রহিমাও এল। সঙ্গে চারটি ছোট ছেলেমেয়ে। হতদরিদ্র অবস্থা। স্বামীর বাড়ি থেকে সে আমার জন্যে দুটা ডালিম নিয়ে এসেছে।
আমার স্ত্রী তাকে খুব যত্ন করে খাওয়াল। খাওয়ার শেষে তাকে শাড়িটি দেওয়া হলো। মেয়েটি অভিভূত হয়ে গেল। এ রকম একটা উপহার বোধহয় তার কল্পনাতেও ছিল না। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। আমি তাকে আমার ঘরে ডেকে নিলাম। কোমল গলায় বললাম, কেমন আছ রহিমা?
রহিমা ফিসফিস করে বলল, ভালো আছি ভাইজান। ‘শাড়ি পছন্দ হয়েছে?’ ‘পছন্দ হইব না! কী কন ভাইজান! অত দামি জিনিস কি আমরা কোনোদিন চউক্ষে দেখছি!’ ‘তোমার ভাইয়ের ব্যাপারটা জানতে চাচ্ছিলাম। তুমি কী করে বুঝলে ভাই বেঁচে আছে?’ রহিমা অনেকটা সময় চুপ করে থেকে বলল, কী কইরা বুঝলাম আমি নিজেও জানি না ভাইজান। মৃত্যুর খবর শুইন্যা দৌড়াইতে দৌড়াইতে আসছি। বাড়ির উঠানে পাও দিতেই মনে হইল মন্তাজ বাঁইচ্যা আছে। ‘কীজন্যে মনে হল?’ ‘জানি না ভাইজান। মনে হইল।’ ‘এইরকম কি তোমার আগেও হয়েছে? মানে কোনও ঘটনা আগে থেকেই কি তুমি বলতে পার?’ ‘জ্বি না।’ ‘মন্তাজ তোমাকে কিছু বলেনি? জ্ঞান ফিরলে সে কী দেখল বা তার কী মনে হল?’ ‘জ্বি না।’ ‘জিজ্ঞেস করনি?’ ‘করছি। হারামজাদা কথা কয় না।’ রহিমা আরও খানিকক্ষণ বসে পানটান খেয়ে চলে গেল। আমার টানা লেখালেখিতে ছেদ পড়ল। কিছুতেই আর লিখতে পারি না। সবসময় মনে হয় বাচ্চা একটি ছেলে কবরের বিকট অন্ধকারে জেগে উঠে কী ভাবল? কী সে দেখল? তখন তার মনের অনুভূতি কেমন ছিল? মন্তাজ মিয়াকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে, আমার মনে হয় জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হবে না। সবসময় মনে হয় বাচ্চা একটি ছেলেকে ভয়স্মৃতি মনে করিয়ে দেওয়াটা অন্যায় কাজ। এই ছেলে নিশ্চয়ই প্রাণপণে এটা ভুলতে চেষ্টা করছে। ভুলতে চেষ্টা করছে বলেই কাউকে কিছু বলতে চায় না। তবু একদিন কৌতূহলের হাতে পরাজিত হলাম।
দুপুরবেলা। গল্পের বই নিয়ে বসেছি। পাড়াগাঁর ঝিম-ধরা দুপুর। একটু যেন ঘুম-ঘুম আসছে। জানালার বাইরে খুট করে শব্দ হল। তাকিয়ে দেখি মন্তাজ। আমি বললাম- কী খবররে মন্তাজ? ‘ভালো।’ ‘বোন আছে না চলে গেছে?’ ‘গেছেগা।’ ‘আয় ভেতরে আয়।’ মন্তাজ ভেতরে চলে এল। আমার সঙ্গে তার ব্যবহার এখন বেশ স্বাভাবিক। প্রায়ই খানিকটা গল্পগুজব হয়। মনে হয় আমাকে সে খানিকটা পছন্দও করে। এইসব ছেলে ভালোবাসার খুব কাঙাল হয়। অল্পকিছু মিষ্টি কথা, সামান্য একটু আদর এতেই তারা অভভূত হয়ে যায়। এই ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে বলে আমার ধারণা। মন্তাজ এসে খাটের এক প্রান্তে বসল। আড়ে আড়ে তোমাকে দেখতে লাগল। আমি বললাম, তোর সঙ্গে কয়েকটা কথা বলি, কেমন? ‘আইচ্ছা।’ ‘ঠিকমতো জবাব দিবি তো?’ ‘হুঁ।’ ‘আচ্ছা মন্তাজ, কবরে তুই জেগে উঠেছিলি, মনে আছে?’ ‘আছে।’ ‘যখন জেগে উঠলি তখন ভয় পেয়েছিলি?’ ‘না।’ ‘না কেন?’ মন্তাজ চুপ করে রইল। আমার দিক থেকে অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নিল। আমি বললাম, কী দেখলি- চারদিক অন্ধকার? ‘হ।’ ‘কেমন অন্ধকার?’ মন্তাজ এবারও জবাব দিল না। মনে হচ্ছে সে বিরক্ত হচ্ছে। আমি বলালম, কবর তো খুব অন্ধকার তবু ভয় লাগল না? মন্তাজ নিচুস্বরে বলল, আরেকজন আমার সাথে আছিল সেইজন্য ভয় লাগে নাই। আমি চমকে উঠে বললাম, আরেকজন ছিল মানে? আরেকজন কে ছিল? ‘চিনি না। আন্ধাইরে কিচ্ছু দেখা যায় না।’ ‘ছেলে না মেয়ে?’ ‘জানি না।’ ‘সে কী করল? ‘আমারে আদর করল। আর কইল, কোনও ভয় নাই।’ ‘কীভাবে আদর করল?’ ‘মনে নাই।’ ‘কী কী কথা সে বলল?’ ‘মজার মজার কথা-খালি হাসি আসে।’ বলতে বলতে মন্তাজ মিয়া ফিক করে হেসে ফেলল। আমি বললাম, কীরকম মজার কথা? দুএকটা বল তো শুনি? ‘মনে নাই।’ ‘কিছুই মনে নাই? সে কে এটা কি বলেছে?’ ‘জ্বি না।’ ‘ভালো করে ভেবেটেবে বল তো-কোনোকিছু কি মনে পড়ে?’ ‘উনার গায়ে শ্যাওলার মতো গন্ধ ছিল।’ ‘আর কিছু?’ মন্তাজ মিয়া চুপ করে রইল। আমি বললাম, ভালো করে ভেবেটেবে বল তো! কিছুই মনে নেই? মন্তাজ মিয়া অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, একটা কথা মনে আসছে। ‘সেটা কী?’ ‘বলতাম না। কথাডা গোপন।’ ‘বলবি না কেন?’ মন্তাজ জবাব দিল না। আমি আবার বললাম, বল মন্তাজ, আমার খুব শুনতে ইচ্ছা করছে। মন্তাজ উঠে চলে গেল। এই তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা।বাকি যে-ক’দিন গ্রামে ছিলাম, সে কোনোদিন আমার কাছে আসেনি। লোক পাঠিয়ে খবর দিয়েছি তবু আসেনি। কয়েকবার নিজেই গেলাম। দূর থেকে দেখতে পেয়ে সে পালিয়ে গেল। আমি আর চেষ্টা করলাম না। কিছু রহস্য সে তার নিজের কাছে রাখতে চায়। রাখুক। এটা তার অধিকার। এই অধিকার অনেক কষ্টে সে অর্জন করেছে। শ্যাওলাগন্ধী সেই ছায়াসঙ্গীর কথা আমরা যদি কিছু নাও জানি তাতেও কিছু যাবে আসবে না।
আমার বেশির ভাগ পরিকল্পনাই শেষ পর্যন্ত কাজে লাগাতে পারি না। এটা কেমন করে জানি লেগে গেল।
একদিন সত্যি সত্যি রওনা হলাম।
আমাদের গ্রামটাকে অজ পাড়াগাঁ বললেও সম্মান দেখানো হয়। যোগাযোগ-ব্যবস্থার এমন সুন্দর সময়েও সেখানে পৌঁছাতে হয় গরুর গাড়িতে। বর্ষার সময় নৌকা, তবে মাঝখানে একটা হাওর পড়ে বলে সেই যাত্রা অগস্ত্যযাত্রার মতো।
অনেকদিন পর গ্রামে গিয়ে ভালো লাগল। দেখলাম আমার বাচ্চাদের আনন্দবর্ধনের সব ব্যবস্থাই নেওয়া হয়েছে। কোত্থেকে যেন একটা হাড়জিরজিরে বেতো ঘোড়া জোগাড় করা হয়েছে। এই ঘোড়া নড়াচড়া করে না, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। খুব বেশি বিরক্ত হলে দীর্ঘনিশ্বাসের মতো একটা শব্দ করে এবং লেজটা নাড়ে। বাচ্চারা এতবড় একটা জীবন্ত খেলনা পেয়ে মহাখুশি। দু-তিনজন একসঙ্গে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসে থাকে।
তাদের অসংখ্য বন্ধু-বান্ধবও জুটে গেল। যেখানেই যায় তাদের সঙ্গে গোটা পঞ্চাশেক ছেলেপুলে থাকে। আমার বাচ্চারা যা করে তাতেই তারা চমৎকৃত হয়। আমার বাচ্চারা তাদের বিপুল জনপ্রিয়তায় অভিভূত। তারা তাদের যাবতীয় প্রতিভা দেখাতে শুরু করল-কেউ কবিতা বলছে, কেউ গান, কেউ ছড়া।
আমি একগাদা বই সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার পরিকল্পনা- পুরোপুরি বিশ্রাম নেওয়া। শুয়ে বসে বই পড়া, খুব বেশি ইচ্ছা করলে খাতা-কলম নিয়ে বসা। একটা উপন্যাস অর্ধেকের মতো লিখেছিলাম, বাকিটা কিছুতেই লিখতে ইচ্ছা করছিল না। পান্ডুলিপি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। নতুন পরিবেশে যদি লিখতে ইচ্ছা করে।
প্রথম কিছুদিন বই বা লেখা কোনোটাই নিয়ে বসা গেল না। সারাক্ষণই লোকজন আসছে। তারা অত্যন্ত গম্ভীর গলায় নানান জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনায় উৎসাহী। এসেই বলবে- ‘দেশের অবস্থাডা কী কন দেহি ছোডমিয়া। বড়ই চিন্তাযুক্ত আছি। দেশের হইলডা কী? কী দেশ ছিল আর কী হইল?’
দিন চার-পাঁচেকের পর সবাই বুঝে গেল দেশ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। গল্পগুজবও তেমন করতে পারি না। তারা আমাকে রেহাই দিল। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। গ্রামের নতুন পরিবেশের কারণেই হোক বা অন্য কোনও কারণেই হোক আমি লেখালেখির প্রবল আগ্রহ বোধ করলাম। অসমাপ্ত পান্ডুলিপি নিয়ে বসলাম। সারাদিন লেখালেখি কাটাকুটি করি, সন্ধ্যায় স্ত্রীকে সঙ্গে করে বেড়াতে বের হই। চমৎকার লাগে। প্রায় রাতেই একজন দুজন করে ‘গাতক’ আসে। এরা জ্যোৎস্নাভেজা উঠোনে বসে চমৎকার গান ধরে-
“ও মনা
এই কথাটা না জানলে প্রাণে বাঁচতাম না।
না না না-আমি প্রাণে বাঁচতাম না।”
সময়টা বড় চমৎকার কাটতে লাগল। লেখার ব্যাপারে আগ্রহ বাড়তেই লাগল। সারাদিনই লিখি।
এক দুপুরের কথা- একমনে লিখছি। জানালার ওপাশে খুট করে শব্দ হলো। তাকিয়ে দেখি খালিগায়ে রোগামতো দশ-এগারো বছরের একটা ছেলে গভীর আগ্রহে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে আগেও দেখেছি। জানালার ওপাশ থেকে গভীর কৌতূহলে সে আমাকে দেখে। চোখে চোখ পড়লেই পালিয়ে যায়। আজ পালাল না।
আমি বললাম- কী রে?
সে মাথাটা চট করে নামিয়ে ফেলল।
আমি বললাম- চলে গেলি নাকি?
ও আড়াল থেকে বলল- না।
‘নাম কী রে তোর?’
‘মন্তাজ মিয়া।’
‘আয় ভেতরে আয়।’
‘না।’
আর কোনও কথাবার্তা হল না। আমি লেখায় ডুবে গেলাম। ঘুঘুডাকা শ্রান্ত দুপুরে লেখালেখির আনন্দই অন্যরকম। মন্তাজ মিয়ার কথা ভুলে গেলাম।
পরদিন আবার এই ব্যাপার। জানালার ওপাশে মন্তাজ মিয়া। বড় বড় কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম- কী ব্যাপার মন্তাজ মিয়া? আয় ভেতরে।
সে ভেতরে ঢুকল।
আমি বললাম, থাকিস কোথায়?
উত্তরে পোকা-খাওয়া দাঁত বের করে হাসল।
‘স্কুলে যাস না?’
আবার হাসি। আমি খাতা থেকে একটা সাদা কাগজ ছিঁড়ে তার হাতে দিলাম। সে তার এই বিরল সৌভাগ্যে অভিভূত হয়ে গেল। কী করবে বুঝতে পারছে না। কাগজটার গন্ধ শুঁকল। গালের উপর খানিকক্ষণ চেপে রেখে উল্কার বেগে বেরিয়ে গেল।
রাতে খেতে খেতে আমার ছোট চাচা বললেন- মন্তাজ হারামজাদা তোমার কাছে নাকি আসে? আসলে একটা চড় দিয়ে বিদায় করবে।
‘কেন?’
‘বিরাট চোর। যা-ই দেখে তুলে নিয়ে যায়। ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দিবে না। দুই দিন পরপর মার খায় তাতেও হুঁশ হয় না। তোমার এখানে এসে করে কী?’
‘কিছু করে না।’
‘চুরির সন্ধানে আছে। কে জানে এর মধ্যে হয়তো তোমার কলম-টলম নিয়ে নিয়েছে।’
‘না, কিছু নেয়নি।’
‘ভালো করে খুঁজে-টুজে দ্যাখো। কিছুই বলা যায় না। ঐ ছেলের ঘটনা আছে।’
‘কী ঘটনা?’
‘আছে অনেক ঘটনা। বলব একসময়।
পরদিন সকালে যথারীতি লেখালিখি শুরু করেছি। হৈচৈ শুনে বের হয়ে এলাম। অবাক হয়ে দেখি মন্তাজ মিয়াকে তিন-চারজন চ্যাংদোলা করে নিয়ে এসেছে। ছেলেটা ফোঁপাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে প্রচন্ড মার খেয়েছে। ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়ছে। একদিকের গাল ফুলে আছে।
আমি বললাম, কী ব্যাপার?
শাস্তিদাতাদের একজন বলল, দেখেন তো এই কলমটা আপনের কি না। মন্তাজ হারামজাদার হাতে ছিল।
দেখলাম কলমটা আমারই, চার-পাঁচ টাকা দামের বলপয়েন্ট। এমন কোনও মহার্ঘ বস্তু নয়। আমার কাছে চাইলেই দিয়ে দিতাম। চুরি করার প্রয়োজন ছিল না। মনটা একটু খারাপই হল। বাচ্চা বয়সে ছেলেটা এমন চুরি শিখল কেন? বড় হয়ে এ করবে কী?
‘ভাইসাব, কলমটা আপনার?’
‘হ্যাঁ। তবে আমি এটা ওকে দিয়ে দিয়েছি। ছেড়ে দিন। বাচ্চা ছেলে এত মারধর করেছেন কেন? মারধর করার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করে নেবেন না?’
শাস্তিদাতা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, এই মাইরে ওর কিছু হয় না। এইডা এর কাছে পানিভাত। মাইর না খাইলে এর ভাত হজম হয় না।
মন্তাজ মিয়া বিস্মিত চোখে আমাকে দেখছে। তাকে দেখেই মনে হল সে তার ক্ষুদ্র জীবনে এই প্রথম একজনকে দেখছে যে চুরি করার পরও তাকে চোর বলেনি। মন্তাজ মিয়া নিঃশব্দে বাকি দিনটা জানালার ওপাশে বসে রইল। অন্যদিন তার সঙ্গে দুএকটা কথাবার্তা বলি, আজ একটা কথাও বলা হল না। মেজাজ খারাপ হয়েছিল। এই বয়সে একটা ছেলে চুরি শিখবে কেন?
মন্তাজ মিয়ার যে একটা বিশেষ ঘটনা আছে তা জানলাম আমার ছোট চাচির কাছে। চুরির ঘটনারও দুদিন পর। গ্রামের মানুষদের এই একটা অদ্ভুত ব্যাপার। কোন ঘটনা যে গুরুত্বপূর্ণ, কোনটা তুচ্ছ তা এরা বুঝতে পারে না। মন্তাজ মিয়ার জীবনের এত বড় একটা ব্যাপার কেউ আমাকে এতদিন বলেনি, অথচ তুচ্ছ সব বিষয় অনেকবার করে শোনা হয়ে গেছে। মন্তাজ মিয়ার ঘটনাটা এই-
তিন বছর আগে কার্তিক মাসের মাঝামাঝি মন্তাজ মিয়া দুপুরে প্রবল জ্বর নিয়ে বাড়ি ফেরে। সেই জ্বরের প্রকোপ এতই বেশি যে শেষ পর্যন্ত মন্তাজ মিয়ার হতদরিদ্র বাবা একজন ডাক্তারও নিয়ে এলেন। ডাক্তার আনার কিছুক্ষণের মধ্যেই মন্তাজ মিয়া মারা গেল। গ্রামে জন্ম এবং মৃত্যু দুটোই বেশ স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা হয়। মন্তাজ মিয়ার মা কিছুক্ষণ চিৎকার করে কাঁদল। তার বাবাও খানিকক্ষণ ‘আমার পুত কই গেলরে’ বলে চেঁচিয়ে স্বাভাবিক হয়ে গেল। বেঁচে থাকার প্রবল সংগ্রামে তাদের লেগে থাকতে হয়। পুত্রশোকে কাতর হলে চলে না। মরা মানুষ যত তাড়াতাড়ি কবর দিয়ে দেওয়া হয় ততই নাকি সোয়াব এবং কবর দিতে হয় দিনের আলো থাকতে থাকতে। কাজেই জুম্মাঘরের পাশে বাদ আছর মন্তাজ মিয়ার কবর হয়ে গেল। সবকিছুই খুব কটা সুযোগ। এই সুযোগ তারা নষ্ট করবে না। আমি আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেউ কি এসেছে? ‘আসব না মানে? গেরামের একটা নিয়ম-শৃঙ্খলা আছে না?’ আমি ছোট চাচাকে বললাম, আমাদের উপলক্ষে যেসব মেয়ে নাইওর আসবে তাদের প্রত্যেককে যেন একটা করে দামি শাড়ি উপহার হিসেবে দেওয়া হয়, একদিন খুব যত্ন স্বাভাবিকভাবে। অস্বাভাবিক ব্যাপারটা শুরু হল দুপুর রাতের পর, যখন মন্তাজ মিয়ার বড় বোন রহিমা কলমাকান্দা থেকে উপস্থিত হল। কলমাকান্দা এখান থেকে একুশ মাইল। এই দীর্ঘ পথ একটি গর্ভবতী মহিলা পায়ে হেঁটে চলে এল এবং বাড়িতে পা দিয়েই চেঁচিয়ে বলল, তোমরা করছ কী? মন্তাজ বাঁইচ্যা আছে। কবর খুঁইড়া তারে বাইর কর। দিরং কবরা না। বলাই বাহুল্য, কেউ তাকে পাত্তা দিল না। শোকে-দুঃখে মানুষের মাথা খারাপ হয়ে যায়। কবর দিয়ে দেওয়ার পর নিকট আত্মীয়-স্বজনরা সবসময় বলে-“ও মরে নাই।” কিন্তু মন্তাজ মিয়ার বোন রহিমা এই ব্যাপারটা নিয়ে এতই হৈচৈ শুরু করল যে সবাই বাধ্য হল মৌলানা সাহেবকেডেকে আনতে। রহিমা মৌলানা সাহেবের পায়ে গিয়ে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, মন্তাজ বাঁইচ্যা আছে- আপনে এরে বাঁচান। আপনে না বললে কবর খুঁড়ত না। আপনে রাজি না হওয়া পর্যন্ত আমি পাও ছাড়তাম না। মৌলানা সাহেব অনেক চেষ্টা করেও রহিমাকে ঝেড়ে ফেলতে পারলেন না। রহিমা বজ্রআঁটুনিতে পা ধরে বসে রইল। মৌলানা সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন- বাঁইচা আছে বুঝলা ক্যামনে? রহিমা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, আমি জানি। গ্রামের মৌলানারা অতি কঠিনহৃদয়ের হয় বলে আমাদের একটা ধারণা আছে। এই ধারণা সত্যি নয়। মৌলানা সাহেব বললেন- প্রয়োজনে কবর দ্বিতীয়বার খোঁড়া জায়েজ আছে। এই মেয়ের মনের শান্তির জন্যে এটা করা যায়। হাদিস শরীফে আছে… কবর খোঁড়া হল। ভয়াবহ দৃশ্য! মন্তাজ মিয়া কবরের গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে। পিটপিট করে তাকাচ্ছে। হঠাৎ চোখে প্রবল আলো পড়ায় চোখ মেলতে পারছে না। কাফনের কাপড়ের একখ- লুঙ্গির মতো পেঁচিয়ে পরা। অন্য দুটি খন্ড সুন্দর করে ভাঁজ করা। অসংখ্য মানুষ জমা হয়ে আছে। এই অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখে কারো মুখে কোনও কথা সরল না। মৌলানা সাহেব বললেন- কীরে মন্তাজ? মন্তাজ মৃদুস্বরে বলল, পানির পিয়াস লাগছে। মৌলানা সাহেব হাত বাড়িয়ে তাকে কবর থেকে তুললেন। এই হচ্ছে মন্তাজ মিয়ার গল্প। আমি আমার এই জীবনে অদ্ভুত গল্প অনেক শুনেছি, এ রকম কখনো শুনিনি। ছোট চাচাকে বললাম, মন্তাজ তারপর কিছু বলেনি? অন্ধকার কবরে জ্ঞান ফিরবার পর কী দেখল না-দেখল এইসব? ছোট চাচা বললেন- না। কিচ্ছু কয় না। হারামজাদা বিরাট বজ্জাত। ‘জিজ্ঞেস করেননি কিছু?’ ‘কত জনে কত জিজ্ঞেস করছে। এক সাংবাদিকও আসছিল। ছবি তুলল। কত কথা জিজ্ঞেস করল-একটা শব্দ করে না। হারামজাদা বদের হাড্ডি।’ আমি বললাম, কবর থেকে ফিরে এসেছে-লোকজন তাকে ভয়-টয় পেত না? ‘প্রথম প্রথম পাইত। তারপর আর না। আল্লাহ্তায়ালার কুদরত। আল্লাহ্তায়ালার কেরামতি আমরা সামান্য মানুষ কী বুঝব কও?’ ‘তা তো বটেই। আপনারা তার বোন রহিমাকে জিজ্ঞেস করেননি সে কী করে বুঝতে পারল মনত্মাজ বেঁচে আছে?’ ‘জিজ্ঞেস করার কিছু নাই। এইটাও তোমার আল্লাহ্র কুদরত। উনার কেরামতি।’ ধর্মকর্ম করুক বা না-করুক গ্রামের মানুষদের আল্লাতায়ালার ‘কুদরত’ এবং কেরামতির’ উপর অসীম ভক্তি। গ্রামের মানুষদের চরিত্রে চমৎকার সব দিক আছে। অতি তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে এরা প্রচুর মাতামাতি করে, আবার অনেক বড় বড় ঘটনা হজম করে। দার্শনিকের মতো গলায় বলে ‘আল্লাহ্র কুদরত’। আমি ছোট চাচাকে বললাম, রহিমাকে একটু খবর দিয়ে আনানো যায় না? ছোট চাচা বিস্মিত হয়ে বললেন, কেন? ‘কথা বলতাম।’ ‘খবর দেওয়ার দরকার নাই। এম্নেই আসব।’ ‘এম্নিতেই আসবে কেন?’ ছোট চাচা বললেন- তুমি পুলাপান নিয়া আসছ। চাইরদিকে খবর গেছে। এই গেরামের যত মেয়ের বিয়া হইছে সব অখন নাইওর আসব। এইটাই নিয়ম। আমি অবাকই হলাম। সত্যি সত্যি এটাই নাকি নিয়ম। গ্রামের কোনো বিশিষ্ট মানুষ আসা উপলক্ষে গ্রামের সব মেয়েনাইওর আসবে। বাপের দেশের আসার এটা তাদের একরে দাওয়াত খাওয়ানো হয়। ছোট চাচা এটা পছন্দ করলেন না। তবে তাঁর রাজি না হয়েও কোনও উপায় ছিল না। আমাদের জমিজমা তিনি দীর্ঘদিন ধরে ভোগদখল করছেন। গ্রামের নিয়মমতো একসময় রহিমাও এল। সঙ্গে চারটি ছোট ছেলেমেয়ে। হতদরিদ্র অবস্থা। স্বামীর বাড়ি থেকে সে আমার জন্যে দুটা ডালিম নিয়ে এসেছে।
আমার স্ত্রী তাকে খুব যত্ন করে খাওয়াল। খাওয়ার শেষে তাকে শাড়িটি দেওয়া হলো। মেয়েটি অভিভূত হয়ে গেল। এ রকম একটা উপহার বোধহয় তার কল্পনাতেও ছিল না। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। আমি তাকে আমার ঘরে ডেকে নিলাম। কোমল গলায় বললাম, কেমন আছ রহিমা?
রহিমা ফিসফিস করে বলল, ভালো আছি ভাইজান। ‘শাড়ি পছন্দ হয়েছে?’ ‘পছন্দ হইব না! কী কন ভাইজান! অত দামি জিনিস কি আমরা কোনোদিন চউক্ষে দেখছি!’ ‘তোমার ভাইয়ের ব্যাপারটা জানতে চাচ্ছিলাম। তুমি কী করে বুঝলে ভাই বেঁচে আছে?’ রহিমা অনেকটা সময় চুপ করে থেকে বলল, কী কইরা বুঝলাম আমি নিজেও জানি না ভাইজান। মৃত্যুর খবর শুইন্যা দৌড়াইতে দৌড়াইতে আসছি। বাড়ির উঠানে পাও দিতেই মনে হইল মন্তাজ বাঁইচ্যা আছে। ‘কীজন্যে মনে হল?’ ‘জানি না ভাইজান। মনে হইল।’ ‘এইরকম কি তোমার আগেও হয়েছে? মানে কোনও ঘটনা আগে থেকেই কি তুমি বলতে পার?’ ‘জ্বি না।’ ‘মন্তাজ তোমাকে কিছু বলেনি? জ্ঞান ফিরলে সে কী দেখল বা তার কী মনে হল?’ ‘জ্বি না।’ ‘জিজ্ঞেস করনি?’ ‘করছি। হারামজাদা কথা কয় না।’ রহিমা আরও খানিকক্ষণ বসে পানটান খেয়ে চলে গেল। আমার টানা লেখালেখিতে ছেদ পড়ল। কিছুতেই আর লিখতে পারি না। সবসময় মনে হয় বাচ্চা একটি ছেলে কবরের বিকট অন্ধকারে জেগে উঠে কী ভাবল? কী সে দেখল? তখন তার মনের অনুভূতি কেমন ছিল? মন্তাজ মিয়াকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে, আমার মনে হয় জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হবে না। সবসময় মনে হয় বাচ্চা একটি ছেলেকে ভয়স্মৃতি মনে করিয়ে দেওয়াটা অন্যায় কাজ। এই ছেলে নিশ্চয়ই প্রাণপণে এটা ভুলতে চেষ্টা করছে। ভুলতে চেষ্টা করছে বলেই কাউকে কিছু বলতে চায় না। তবু একদিন কৌতূহলের হাতে পরাজিত হলাম।
দুপুরবেলা। গল্পের বই নিয়ে বসেছি। পাড়াগাঁর ঝিম-ধরা দুপুর। একটু যেন ঘুম-ঘুম আসছে। জানালার বাইরে খুট করে শব্দ হল। তাকিয়ে দেখি মন্তাজ। আমি বললাম- কী খবররে মন্তাজ? ‘ভালো।’ ‘বোন আছে না চলে গেছে?’ ‘গেছেগা।’ ‘আয় ভেতরে আয়।’ মন্তাজ ভেতরে চলে এল। আমার সঙ্গে তার ব্যবহার এখন বেশ স্বাভাবিক। প্রায়ই খানিকটা গল্পগুজব হয়। মনে হয় আমাকে সে খানিকটা পছন্দও করে। এইসব ছেলে ভালোবাসার খুব কাঙাল হয়। অল্পকিছু মিষ্টি কথা, সামান্য একটু আদর এতেই তারা অভভূত হয়ে যায়। এই ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে বলে আমার ধারণা। মন্তাজ এসে খাটের এক প্রান্তে বসল। আড়ে আড়ে তোমাকে দেখতে লাগল। আমি বললাম, তোর সঙ্গে কয়েকটা কথা বলি, কেমন? ‘আইচ্ছা।’ ‘ঠিকমতো জবাব দিবি তো?’ ‘হুঁ।’ ‘আচ্ছা মন্তাজ, কবরে তুই জেগে উঠেছিলি, মনে আছে?’ ‘আছে।’ ‘যখন জেগে উঠলি তখন ভয় পেয়েছিলি?’ ‘না।’ ‘না কেন?’ মন্তাজ চুপ করে রইল। আমার দিক থেকে অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নিল। আমি বললাম, কী দেখলি- চারদিক অন্ধকার? ‘হ।’ ‘কেমন অন্ধকার?’ মন্তাজ এবারও জবাব দিল না। মনে হচ্ছে সে বিরক্ত হচ্ছে। আমি বলালম, কবর তো খুব অন্ধকার তবু ভয় লাগল না? মন্তাজ নিচুস্বরে বলল, আরেকজন আমার সাথে আছিল সেইজন্য ভয় লাগে নাই। আমি চমকে উঠে বললাম, আরেকজন ছিল মানে? আরেকজন কে ছিল? ‘চিনি না। আন্ধাইরে কিচ্ছু দেখা যায় না।’ ‘ছেলে না মেয়ে?’ ‘জানি না।’ ‘সে কী করল? ‘আমারে আদর করল। আর কইল, কোনও ভয় নাই।’ ‘কীভাবে আদর করল?’ ‘মনে নাই।’ ‘কী কী কথা সে বলল?’ ‘মজার মজার কথা-খালি হাসি আসে।’ বলতে বলতে মন্তাজ মিয়া ফিক করে হেসে ফেলল। আমি বললাম, কীরকম মজার কথা? দুএকটা বল তো শুনি? ‘মনে নাই।’ ‘কিছুই মনে নাই? সে কে এটা কি বলেছে?’ ‘জ্বি না।’ ‘ভালো করে ভেবেটেবে বল তো-কোনোকিছু কি মনে পড়ে?’ ‘উনার গায়ে শ্যাওলার মতো গন্ধ ছিল।’ ‘আর কিছু?’ মন্তাজ মিয়া চুপ করে রইল। আমি বললাম, ভালো করে ভেবেটেবে বল তো! কিছুই মনে নেই? মন্তাজ মিয়া অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, একটা কথা মনে আসছে। ‘সেটা কী?’ ‘বলতাম না। কথাডা গোপন।’ ‘বলবি না কেন?’ মন্তাজ জবাব দিল না। আমি আবার বললাম, বল মন্তাজ, আমার খুব শুনতে ইচ্ছা করছে। মন্তাজ উঠে চলে গেল। এই তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা।বাকি যে-ক’দিন গ্রামে ছিলাম, সে কোনোদিন আমার কাছে আসেনি। লোক পাঠিয়ে খবর দিয়েছি তবু আসেনি। কয়েকবার নিজেই গেলাম। দূর থেকে দেখতে পেয়ে সে পালিয়ে গেল। আমি আর চেষ্টা করলাম না। কিছু রহস্য সে তার নিজের কাছে রাখতে চায়। রাখুক। এটা তার অধিকার। এই অধিকার অনেক কষ্টে সে অর্জন করেছে। শ্যাওলাগন্ধী সেই ছায়াসঙ্গীর কথা আমরা যদি কিছু নাও জানি তাতেও কিছু যাবে আসবে না।
0 Response to "ছায়াসঙ্গী"
Post a Comment