Search Any Post...

[ছোট গল্প] শেষ হয়েও হল না শেষ

শেষ হয়েও ... - সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

টেবিলের কোনায় পড়ন্ত বিকেলের একটুকরো রোদ এসে পড়েছে। দক্ষিন পূর্ব বাভারিয়ায় গ্রীষ্মের তুলনা হয়ত পৃথিবীর কোথাও নেই। ঝিরিঝিরে হাওয়া, নরম সোনালি রোদ। গাছের পাতা গুলো মনে হচ্ছে হালকা সবুজ মাখনের তৈরি, যেন আর একটু রোদ পেলেই গলতে শুরু করবে। এ অঞ্চলের লোকজন ভারি হাসিমুখ। একটু গাঁইয়া বটে, কিন্তু হাঁদা হবার সুবিধে আছে। যাই বোঝানো হোক, ঝটপট বুঝে যায়। বিংশ শতকের শুরু থেকেই জীবনের লয় দ্রুত হতে শুরু করেছে। এই ১৯৩৭ সালের কেজো পৃথিবীর সঙ্গে গত শতকের অভিজাত ধীরলয়ের জীবনের অনেক পার্থক্য। সে জীবনে গতি ছিলোনা বটে, কিন্তু আভিজাত্য ছিলো, চিন্তার খোরাক ছিলো, মাথা খাটাবার জায়গা ছিলো, সুক্ষতা ছিলো, শিল্পের ছোঁয়া ছিলো সব কিছুর মধ্যেই, এমনকি অপরাধ ও অনেক......।
বারান্দার নিচে একটা ঢাউস কালো চক্‌চকে মোটরগাড়ি এসে দাঁড়ালো। অলস চোখে সেদিকে তাকালেন বর্ষীয়ান প্রোফেসর। চোখ কোটরে ঢুকে গেছে। পিঠ বেঁকে দুমড়ে গেছে। শনের মত দু চার গাছি সাদা চুল অবশিষ্ট রয়েছে। ঈগলের মত বাঁকা নাক, চোখা থুতনি আর চোখের তীব্র নীল দৃষ্টি এখনো অনেক মানুষকে থমকে দাঁড় করিয়ে দেয়। তবে কিনা, এই অজ্ঞাতবাসে কেটে গেল অনেক গুলো বছর। লোকালয় থেকে একটু বাইরে এই বাড়িটায় তিনি গত ১৪ বছর রয়েছেন। তার আগে কাছাকাছি গাঁয়ে ভাড়া থাকতেন। একদম কাছেই অস্ট্রিয়া সীমান্ত। এ অঞ্চলটা জার্মানির মধ্যে পড়লেও পূব-দক্ষিন-পশ্চিম তিন দিকেই অস্ট্রিয়া দিয়ে ঘেরা। পায়ে হেঁটেই সীমানা পেরিয়ে যাওয়া যায়। আগে তো পাহারাও থাকতো না। মহাযুদ্ধের পর অবশ্য ডান্ডা হাতে পুলিশ টহল দেয়। তবে এই পাহাড়-জঙ্গলের মধ্যে কতটুকুই বা পাহারা দেওয়া সম্ভব। সুইস সীমানাও বেশি দূরে নয়। লেক-কন্সস্ট্যান্স পার হলেই ওপারে সুইটৎসারল্যান্ড। ওই রাস্তা ধরেই তো প্রথম বার এখানে এসে অজ্ঞাতবাসের ডেরা খুঁজে বের করেছিলেন তিনি। তার পরে কেটে গেছে ৫০টা বছর। এখন তিনি ছিয়ানব্বই। শরীর আর দেয়না। তবু মাথা কাজ করে চলেছে। এই পাহাড়ের খাঁজে লুকিয়ে থাকা ছোট্ট গাঁ বার্ষটেশগাডেনে নিশ্চিন্তে দেশ বিদেশ থেকে লোকজন আসে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে।
কাঠের সিঁড়িতে ধুপ ধাপ শব্দ। তিনি জানেন মোটরে করে কে এসেছে। তাঁর একনিষ্ঠ ভক্ত। গত আঠেরো বছর ছোকরা তাঁর কাছে ঘোরাফেরা করছে। শিখেছে অনেক। অনেক কিছুই করেছে।কিন্তু জার্মান মাথা তো, ইঞ্জিনিয়ারিং বা বিজ্ঞানে মাথা খুললেও বাদবাকি ব্যাপারে ভোঁতা। এ ছোকরা আবার ফৌজে ছিলো। কাজেই আরো একটু বেশীই মোটা দাগের। যদিও তাঁর কথা দেববাক্য হিসেবে মান্য করে। তবুও মাত্রাজ্ঞানের নিতান্ত অভাব, তার ওপরে সুক্ষতা, শিল্প এসবের সে মোটেই ধার ধারেনা। থাকতো যদি গত শতাব্দীর ......।
ভাবতে ভাবতেই ধুড়ুম করে দরজা খুলে শিষ্যের আগমন। পেছন পেছন খানতিনেক চ্যালা। কেন যে এরা লেজুড় ছাড়া চলতে পারে না! চ্যালা...। মনে পড়ে গেল অনেক পুরোনো কথা। হালকা হাসলেন প্রোফেসর নিজের মনে। প্রবলতম প্রতিদ্বন্দী তাঁর। নাঃ সে ও চ্যালা ছাড়া চলতোনা। একবারই চেষ্টা করেছিলো, তার পর তো ......।
- মাই বয়, কতবার বলেছি আমার ঘরে বেশী লোক আমি পছন্দ করিনা।
- এজ টুট মির লাইড হের প্রোফেসর, আই অ্যাম ভেরি সরি, আমি বলছি এদের চলে যেতে। য়প, রুডি, হারমান তোমরা নিচে অপেক্ষা করো। আমি আধঘন্টায় আসছি।
তিনজন থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলেন ঘর থেলে। এই আইরিশ বুড়োর বদমেজাজের কাছে তাদের গুরু কেন এতটা হেঁহেঁ করেন সেটা পরিস্কার নয়। গুরু আর বৃদ্ধ প্রোফেসর, দুজনেরই কড়া হুকুম আছে, এই সাক্ষাৎকার এমনকি প্রোফেসরের অস্তিত্বটুকু যেন কাকপক্ষিতেও না জানতে পারে।
- হারমান একটা হোঁৎকা মাথামোটা। রুডিও ফক্কা, ওর এক কান দিয়ে তাকালে অন্য কানের ফুটো দিয়ে আকাশ দেখা যায়। একমাত্র য়পের মধ্যে কিছুটা সুক্ষতা আছে মাই বয়, কিন্তু সেও অন্ধ আনুগত্যে তোমাকে সঠিক পরামর্শ দিতে পারছেনা। তোমার চ্যালাদের আমি ভালো চোখে দেখিনা। তুমি জানো।
- আমি জানি প্রোফেসর, কিন্তু এরা আমাকে এক মুহুর্ত চোখের আড়াল করতে চায়না।
- নিজের জন্যে আলাদা সময় রাখতে শেখো মাই ডিয়ার বয়, না হলে মাথা খেলবে কি করে? নতুন পরিকল্পনা আসবে কি করে? সুক্ষতা আসবে কি করে? আর্ট ব্যাপারটা অত ফ্যালনা নয়।
- আপনি তো জানেন প্রোফেসর, আমি নিজে ছবি আঁকতাম, এবং খারাপ আঁকতাম না, শিল্প বুঝিনা একথা.........
- গত পনেরো বছর ঠেকো রোদে দাঁড়িয়ে চড়া গলায় চেল্লামেল্লি করে তোমার ভেতরের আর্টিস্ট শুখিয়ে গেছে মাই বয়। আর তোমার এই চ্যালাচামুন্ডাদের ভেতরেও কেউ সেই যোগ্যতা রাখেনা।
- আলবার্টও না? আপনি তো দেখেছেন তার সৃষ্টি।
- ছোঃ। স্রেফ মোমবাতি, ওভালটিনের কৌটো আর দেশলাই বাক্সর মত দেখতে বিকট কিছু কংক্রিটের দামড়া চাঁই তৈরি করেছে তোমার সাধের স্থপতি। তুমি আইফেল টাওয়ার দেখেছ?
- প্রোফেসর, আপনি জানেন, ওই ফরাসি বেলেল্লাগুলোর মুন্ডু আমি স্টিম রোলারের...... ।
- অন্য সব কাজের মত ক্রাইমের একটা ডিগিনিটি থাকা দরকার ডিয়ার বয়, একটা সুক্ষতা, একটা ওস্তাদের হাতের ছোঁয়া। ওয়ার্ক অফ আর্ট। না হলে তোমাতে, আর হুন সর্দার আত্তিলা তে তফাত কি রইল বলতে পারো? ব্লাডি ভ্যান্ডালিজম।
দরজায় টোকা দিয়ে ঘরে ঢুকলো জিম। জিমের বয়স আশি পেরিয়েছে। প্রোফেসরের একসময়ের শিষ্য সেবাস্টিয়ানের আর্দালী এই জিম। কর্নেল সেবাস্টিয়ানের সঙ্গে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে ছিলো সে। আফগান যুদ্ধে একটা পা হারায়। লন্ডনে সেবাস্টিয়ান বেঘোরে মারা যাবার পর জিম একা হয়ে পড়ে। সেই থেকে প্রোফেসরের আশ্রয়েই রয়েছে সে। জিমের হাতে চায়ের ট্রে। খাঁটি ব্রিটিশ, বিকেলের চা খাওয়ার অভ্যেস এত বছর এই কফিখোর জার্মানদের মধ্যে থেকেও ছাড়তে পারেননি প্রোফেসর। তাঁর দেখাদেখি তাঁর এখনকার শিষ্যও চায়ের অভ্যেস ধরেছে। তাঁরই মত দুধ চিনি ছাড়া কালো চা, আর সঙ্গে কিছু হান্টলি পামারের খাঁটি ব্রিটিশ বিস্কুট। দুটোই নিয়মিত আনানো হয়ে থাকে লন্ডন থেকে।
- সেদিন ওই চশমাপরা ছোকরা এসেছিলো, গোলগাল মুখ, ওকে আমার বেশ লেগেছে। মাথাটি ঠান্ডা, কিছুটা আত্মমগ্ন। এরকম ছেলে আমার পছন্দ মাই বয়।
- হাইনরিখ?
- তাই বোধহয় নামটা।

0 Response to "[ছোট গল্প] শেষ হয়েও হল না শেষ"

Post a Comment

প্রতি ক্লিকে ইনকাম